বিআইডব্লিউটিএর জন্য ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে খুবই ধীরগতিতে। নদীপথে সহজে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর শুরু হয় কাজ। এরপর এক দফা সংশোধন করা হয়েছে। তার পরও গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ।
এদিকে ড্রেজার ও জলযানের নির্মাণকাজ মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট)। তবে পরামর্শক হিসেবে বুয়েটের এক ছাত্র সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএর বহরে মাত্র ২৫টি ড্রেজার রয়েছে। তাতে বছরে মাত্র ১১৪ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা যায়। বেসরকারি ড্রেজারসহ সব মিলিয়ে ড্রেজিং সক্ষমতা বছরে প্রায় ৮৪৬ লাখ ঘনমিটার। আর বিআইডব্লিউটিএর চাহিদা প্রায় ১ হাজার ৬৫৫ লাখ ঘনমিটার। অর্থাৎ বছরে বার্ষিক ঘাটতি থাকছে ৮০৮ ঘনমিটার। প্রকল্পটি ২০১৮-এর ১ অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। সংশোধন করে দুই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকার প্রকল্প খরচ ৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। প্রকল্পটি ৬১টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকা হচ্ছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর, মানিকগঞ্জের শিবালয় ও আরিচা, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, শিমুলিয়া ও মাদারীপুর সদর উপজেলা। এ ছাড়া বরিশালের বরিশাল সদর উপজেলা, বাগেরহাটের রামপাল, গাইবান্ধা সদর, কক্সবাজার সদর, সিলেটের ছাতক ও সদর উপজেলা এবং জামালপুরের সদর উপজেলা রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দুটি ডাবল কেবিন পিকআপ ভ্যানগাড়ি কেনার জন্য ২০২০ সালের ২২ মার্চ টেন্ডার আহ্বান করার পর প্রায় ৮৫ কোটি টাকায় ভ্যান দুটি কেনা হয়। একইভাবে একটি জিপগাড়ি কেনার জন্য ২০২০ সালের ২৩ মার্চ টেন্ডার আহ্বান করার পর ৭ জুন ৫৭ কোটি টাকায় সেটি কেনা হয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি ভালোই ছিল। তবে ড্রেজার কেনা প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ সময় চলে গেলেও মাত্র ৪০টি সহায়ক জলযান ও কিছু আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা ছাড়া মূল কাজে অগ্রগতি হয়নি।
প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করতে সরকার গত (২০২৩-২৪) অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৪৭০ কোটি টাকা বরাদ্দও দিয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলারসংকটের কারণে এলসি খুলতে পারছে না বলে প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে আইএমইডি মনে করে। আবার যেসব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে, তা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে এসব যন্ত্রপাতি মাঠপর্যায়ে কোথায় অবস্থান করছে, তা জানতে পারেনি আইএমইডির টিম।
এদিকে প্রকল্পের কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে বুয়েটকে। কিন্তু সরেজমিনে বুয়েটের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে বুয়েটের একজন ছাত্র প্রকল্পের তত্ত্বাবধানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনিই কাজের মান তদারকি করেন, যা কাম্য নয়। এভাবে সব দিক থেকে কাজের ব্যাপারে ঘাটতি দেখা গেছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মেরিন) মো. মজনু মিয়া খবরের কাগজকে জানান, জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। বুয়েটের ছাত্র প্রকল্প মনিটর করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মনিটরিংকারী একজন নৌ-স্থাপত্য বিষয়ের স্নাতক প্রকৌশলী। বুয়েট থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। সে কারণে অধ্যায়নরত ছাত্র প্রকল্প কাজ মনিটর করেন। সিনিয়র পরামর্শকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলমান কাজ জুনিয়র পরামর্শকরা তদারকি করে থাকেন। এ ছাড়া সিনিয়র পরামর্শকরাও নিয়মিত কাজের তদারকি করেন।
আগামী এক বছরে কি ৭৭ শতাংশ কাজ করা সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজ চুক্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালে সম্পন্ন করা হবে। কাজের ধীরগতির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমদানি করা বিভিন্ন মালামালের সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটায় মালামাল আমদানিতে বিলম্ব হচ্ছে। এ জন্য প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের অগ্রগতি প্রত্যাশার তুলনায় কম হচ্ছে।’
প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনো প্রকল্প পরিচালক পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালন করেননি। ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আবদুল মতিন ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মেরিন) গোলাম মোহাম্মদ ২০২২ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। মো. মজনু মিয়াও ২০২২ সালের ২ নভেম্বর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকল্পের কাজ ভালোমতো দেখভাল করতে তিন মাস পরপর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা হওয়ার কথা। এ প্রকল্পে তা মানা হয়নি। দীর্ঘ সময়ে এ পর্যন্ত মাত্র ৯টি পিআইসি ও ৮টি পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।