প্রশাসনের শীর্ষ পদে একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আগে বিশেষজ্ঞদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার নজির থাকলেও এখন ‘ঢালাওভাবে’ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৮৩ সচিবের মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ দুই পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ ২০ জনই চুক্তিতে কর্মরত। ফলে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা যথাসময়ে সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ ধরনের নিয়োগ নিয়ে খোদ সরকার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যেই ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে।
তাদের মতে, একজন কর্মকর্তা চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে গেলে সেই পদ খালি হয়। ওই পদে নতুন একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি বা পদায়ন হয়। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে বঞ্চিত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এতে সরকার যতটা না উপকৃত হয়, তার চেয়ে বেশি লাভ হয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের।
অতীতে কোনো প্রকল্প বা বিশেষ কারণে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হতো। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। ব্যক্তিগত সখ্য ও রাজনৈতিক বিশেষ তদবিরের কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগে একাধিক সচিবকে এক বা দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ শেষে কারও কারও চুক্তির মেয়াদ আরও বেড়েছে।
বিএনপির আমলেও রেকর্ডসংখ্যক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়। অনেকে মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে রেকর্ড গড়ে, তার জন্য অন্যতম প্রধান দায়ী এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত আমলারাই। দুর্নীতি করতে তারা কোনো রকম রাখঢাক করেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় একটি প্রভাবশালী মহল ভুল বুঝিয়ে একের পর এক চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে। তবে সরকার যদি কাউকে কোনো মন্ত্রণালয়ে অপরিহার্য মনে করে, সে ক্ষেত্রে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া স্বাভাবিক। তবে ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়া অনুচিত। সাম্প্রতিক সময়ে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়ায় পদোন্নতিযোগ্য ও সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
এদিকে বিগত কয়েক বছর জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমেছিল। বিশেষ করে নিয়মিত পদগুলোতে চুক্তিতে কম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু আগে থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়া শুরু হয়। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত কাউকে চুক্তিতে নিয়োগের ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। সে জন্য শীর্ষ পদ পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে চুক্তিতে নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতে সরকারের বাড়তি ব্যয়ও হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে অবসর নিতে হয় ৫৯ বছর বয়সে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও এক বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পান।
বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জনপ্রশাসনে শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের অবসরের সময় এগিয়ে আসছে, এখন তাদের অনেকেই চুক্তিতে নিয়োগ পেতে চেষ্টা-তদবির করছেন। জনপ্রশাসনে এখন সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৮৩ জন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সচিব-পদ শূন্য হয়। যেহেতু নির্বাচন ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেই কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেন। সে ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বর্তমানে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন, তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষে সেখানে নতুন অনেককে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সব সময় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও রয়েছে। কারণ একজনকে নিয়োগ দিলে এ ক্ষেত্রে যার সুযোগ ছিল তিনি বঞ্চিত হন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বিষয়টি খেয়াল রাখেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেন, বিশেষ কারণে ওই সময়ে (সংসদ নির্বাচনের আগে) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়েছিল। তার মতে, এটা করা হয়েছিল দেশের স্বার্থে ও কল্যাণে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান বলেন, তারা চাকরিতে থাকাকালে যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিতেন। কারণ পদোন্নতিযোগ্যদের বঞ্চিত করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে প্রশাসনে নানামুখী সমস্যা তৈরি হয়। পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৪ সালে কমিশনের সুপারিশ ছিল শুধু কারিগরি কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন, তাকে ছাড়া মন্ত্রণালয়ে গতি আসবে না -এমন অপরিহার্য হলে সেই ধরনের কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে তা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়। তাই যারা পদোন্নতির যোগ্য, তাদেরই পদোন্নতি দেওয়া উচিত।’
সূত্র বলছে, প্রশাসনে অতীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের লাগাম টেনে ধরতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পরিহার করার জন্য ২০১৪ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ইসমাত আরা সাদেকের উদ্দেশ্যে একটি আধা সরকারিপত্রও (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন তিনি।
লিখেছিলেন, ‘অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে সরকার কাউকে যদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে, সে ক্ষেত্রে ক্যাডারবহির্ভূত বিশেষ পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এটি কার্যকর হলে নিয়মিত পদোন্নতিপ্রত্যাশী কর্মকর্তারা শীর্ষ পদে আসীন হতে পারবেন। কোনো পক্ষের আর হতাশা ও ক্ষোভ থাকবে না।’
তার প্রস্তাবটিও আমলে নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে দেওয়া পে-কমিশনের সুপারিশে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। সেটিও আমলে নেওয়া হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে চুক্তিতে নিয়োগ বেড়েছে।
জনপ্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন। এর মধ্যে মো. মাহবুব হোসেন গত বছরের (২০২৩) ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। নিয়ম অনুযায়ী তাকে অবসর দিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর পৃথক আরেকটি প্রজ্ঞাপনে ১৪ অক্টোবর থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে এ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব থাকাকালে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর মুখ্যসচিব হিসেবে নিয়োগ পান তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের (২০২৩) ৪ জুলাই তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই বছরের (২০২৩) ২৫ জুন অবসরোত্তর ছুটি এবং এ-সংক্রান্ত সুবিধা স্থগিতের শর্তে ৫ জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।
এদিকে আরও এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব হিসেবে ইতোমধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী এক বছর মেয়াদে এ পদে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গত ২৬ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স নির্বাহী কমিটির প্রধান পরামর্শক পদে মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আলী হোসেন, জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সিনিয়র সচিব) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আব্দুস সালাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সিনিয়র সচিব) মো. আখতার হোসেন, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার চুক্তিতে কর্মরত আছেন।
তালিকায় আরও আছেন, জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) শাহাবুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) মো. ফজলুল বারী, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (লিয়েনে কর্মরত) বেগম শরিফা খান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম।
বর্তমানে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সচিব হিসেবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। এর ফাঁকেও প্রশাসনের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদোন্নতিপ্রত্যাশী বিসিএস ১৫তম ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে খবরের কাগজকে বলেন, সচিব পদোন্নতি পাওয়ার সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। একের পর এক চুক্তি দেওয়ায় তারা কবে সচিব পদোন্নতি পাবেন তা নিয়ে হতাশায় রয়েছেন। কারণ একজনকে চুক্তিতে দিলে আরও ৫ জনের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে তারাও পদোন্নতির আগে মনোকষ্ট নিয়ে অবসরে চলে যাবেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় আনেন না। সুবিধাভোগী আমলারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল বুঝিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে প্রভাবিত করছেন। এটি প্রশাসনের জন্য আদৌ কাম্য নয়।
তাদের অভিমত, নিয়মানুযায়ী সচিবের পদ শূন্য হওয়ার পর যোগ্য কর্মকর্তারাই ওই পদে পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু তা যেন অধরাই থাকছে। উল্টো ওই পদে থাকা সেই কর্মকর্তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় সচিব পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।