
ব্যবসায়ী নামধারী কিছু অসাধু ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে নতুন নতুন কৌশলে অর্থ পাচার করে চলেছেন। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এসব ব্যক্তির একটি প্রতিষ্ঠান ধরা পড়লে অন্য নামে আবারও প্রতিষ্ঠান খুলে পাচারকাজ চালানো হয়। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে অর্থ পাচারের নতুন এ কৌশলের কথা জানা যায়।
শুল্ক গোয়েন্দারা তদন্তে নিশ্চিত হয়েছেন, নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে পাচারকারীরা অনেক সময় আগের প্রতিষ্ঠানের কারখানার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। অনেকে আবার আগের প্রতিষ্ঠানের বন্ডেডওয়্যার হাউস এবং বিদেশে বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাও ব্যবহার করেছেন। বন্দর থেকে পণ্য খালাস এবং বন্দরে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যক্তিদের কাজে লাগানো হয়েছে। অনেক সময় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে একই দোকান ব্যবহার করা হয়েছে। একই কায়দায় ব্যাংকিং চ্যানেলেও জাল কাগজপত্র দিয়ে অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচারকারীরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ পাঠিয়ে বিদেশেই নিজেদের অনুকূলে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আগেই বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা সমঝোতা করে রাখেন।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফকরুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার রুখতে শুল্ক গোয়েন্দারা জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন। পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশলে অর্থ পাচারের চেষ্টা করছেন। শুল্ক গোয়েন্দারা পাচারের সব পথ আটকে দিয়ে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে কাজ করছেন।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আরএস প্যাকেজিং লি., সফুরা ইলেকট্রিক লি., খান সাফামারওয়া এক্সেসরিজ লি., জাহান সোয়েটার লি., এন গার্মেন্টস লি., বালি ফ্যাশান লি., মিম প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ লি., প্যান্টা স্টাইল লি., আরটিএন ফ্যাশান লি., সানবার্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রা.) লি., টিআরআই স্টার ফ্যাশান, ওয়েগা ডিজাইন লিমিটেডসহ ২৩ প্রতিষ্ঠানের চার বছরের (২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত সব তথ্য খতিয়ে দেখা হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে নামসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ২৭৫ চালানে ৯৩২ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই ২৩ প্রতিষ্ঠান জানুয়ারিতে অকার্যকর (ভ্যাট নিবন্ধন বা বিআইএন- ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর বাতিল, লাইসেন্স স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ) করা হয়েছে। এগুলোর একটিরও প্রকৃত মালিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে কোন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঁচামাল কিনেছে এবং কার কাছে রপ্তানি পণ্য পাঠিয়েছে, গোয়েন্দারা তার তালিকা বের করেছেন।
এসব প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করার পর আবারও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির তথ্যে গরমিল পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে গত মার্চে নতুনভাবে ৭৩ কোটি টাকা পাচারের জন্য সানবার্ড প্যাকেজিং লি., শান ইলেট্রনিকস লি., অটোয়া গার্মেন্টস লি., ডায়মন্ড রিং প্যাকেজিং লি. এবং খানস গার্মেন্টস লি. নামের পাঁচ প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে।
তদন্তে দেখা যায়, আগের ২৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সফুরা ইলেকট্রিক লি., জাহান সোয়েটার লি., এন গার্মেন্টস লি., মিম প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ লি., প্যান্টা স্টাইল লিমিটেড এবং নতুন পাঁচ প্রতিষ্ঠানের দেশের মধ্যে কারখানার একই ঠিকানা। বিদেশে বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের একই ঠিকানা। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের পাঁচটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থ পাচারকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া আছে তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। ২৮ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে ৪৯ ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ব্যক্তির অনেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে কম বেতনের চাকরিজীবী। অনেকে গ্রামে থাকেন, কৃষিকাজ করেন। অনেকে আবার জমি বেচাকেনার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেন। এই ৪৯ ব্যক্তির মধ্যে ৭ জন আত্মগোপনে রয়েছেন। শুল্ক গোয়েন্দারা তাদের সন্ধানে কাজ করছেন।
২৮ প্রতিষ্ঠানের কারখানার ঠিকানায় শুল্ক গোয়েন্দারা গিয়ে দেখেন, এসব প্রতিষ্ঠানের একটিও উৎপাদনে নেই। ১২টি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় দোকানপাট, ৯টির ঠিকানায় আবাসন ভবন, ৬টির ঠিকানায় পরিত্যক্ত কারখানা এবং ১টির ঠিকানায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে।
তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ২৮ প্রতিষ্ঠান বেশি পরিমাণের, বেশি দামের কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কম পরিমাণের, কম দামের পণ্য আমদানি করেছে। প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি পরিমাণের অর্থ পাঠিয়ে পাচার করা হয়েছে। কাঁচামাল দিয়ে কোনো পণ্য উৎপাদন করা হয়নি। খোলাবাজার থেকে নামমাত্র মূল্যে নিম্নমানের পণ্য কিনে রপ্তানিকারকরা পণ্য হিসেবে পাঠিয়েছে। জাল কাগজপত্র দিয়ে প্রণোদনা নেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচারকারীদের ভাড়া করা এজেন্ট দিয়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাস, রপ্তানি করা পণ্য পাঠানো, প্রণোদনার অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।
তদন্তকালে এই ২৮ প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় কোন দেশের কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোন পণ্য কত দামে আমদানি করেছে, আমদানিকারকরা কাঁচামাল দিয়ে কতটা পণ্য উৎপাদন করেছে, উৎপাদিত পণ্য কোন দেশে কতটা রপ্তানি করেছে, রপ্তানির মূল্য হিসেবে কতটা পণ্য দেশে আনা হয়েছে, প্রণোদনা হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠান কতটা অর্থ গ্রহণ করেছে, তাও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দারা প্রতিটি কারখানার ঠিকানায় উপস্থিত হয়েছেন, বন্ডেডওয়্যার হাউসে গিয়ে কতটা পণ্য মজুত করা হয়েছে, সেখান থেকে কতবারে কতটা পণ্য বের করে নিয়ে কারখানায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা তদন্ত করেছেন। ২৩ প্রতিষ্ঠানের কারখানার মালিক কে বা কারা, পণ্য খালাস করতে কে বা কারা বন্দরে উপস্থিত হয়েছেন, তার খোঁজ নেওয়া হয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচারের ঘোর বিরোধী। যারা অর্থ পাচার করে তারা প্রকৃত ব্যবসায়ী না, ব্যবসায়ী নামধারী অপরাধী। এদের ধরিয়ে দিতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহযোগিতা করছেন। তবে এটাও ঠিক যে এসব অসাধু ব্যক্তিরা আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত সরকারি অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থ পাচার করে থাকেন। তাই ব্যবসায়ী নামধারী অসাধু ব্যক্তিদের পাশাপাশি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কর্মরত অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘পাচারকারীরা সাধারণত প্রভাবশালী ও সমাজের ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন। তারা আড়ালে থেকে অর্থ পাচারের মতো অপকর্ম করছেন। তাদের ধরতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অর্থ পাচারের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’