
গতকাল বুধবার বেলা প্রায় সোয়া দুইটা। ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতের সামনের রাস্তায় হঠাৎ করেই যেন আশপাশের সব চোখ নিবিষ্ট হলো একটি দৃশ্যে। হাতকড়া পরা এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার মেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এর মধ্যেই এস এম শিবলী নোমান নামের ওই ব্যক্তিকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ।
পরে বৃদ্ধের ছেলে বাহারুল উলুম রাওহা খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ২৩ জুলাই তারিখে মালিবাগে সিআইডি অফিসে হামলা হয়েছে- এমন অভিযোগে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় আমার বাবাকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ। অথচ ঘটনার আগে গত ১৮ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই আমার বাবা ঢাকাতেই ছিলেন না! তিনি ছিলেন ভোলায়। এই মামলায় আদালত আমার বাবাকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।’
ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাওহা বলেন, ‘আমার বাবার বিরুদ্ধে ব্যবসাসংক্রান্ত একটি মামলা আছে। সিআইডির একজন কর্মকর্তা ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। বাবা সিআইডি অফিসে গিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে একটি নথি সংগ্রহ করতে। বাবার সঙ্গে আরেক আঙ্কেলও ছিলেন। কর্মকর্তার সঙ্গে কথা শেষ করে বাবা ওই কর্মকর্তাসহ তিনজন বাইরে এসে চা পান করেন। পরে কর্মকর্তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উনারা আমাদের বাসা বসিলার উদ্দেশে মোহাম্মদপুরের বাসের জন্য মালিবাগে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করেন। এ সময় ছয়জন সাধারণ পোশাকের লোক এসে নিজেদের সিআইডি পরিচয় দিয়ে বাবা এবং আঙ্কেলকে দুই দিকে নিয়ে যান। তারপর আঙ্কেলকে ছেড়ে দেয় এবং আমরা আঙ্কেলের কাছ থেকে এসব ঘটনা শুনতে পাই। পরে খোঁজখবর রাখি। জানলাম যে আজ (বুধবার) বাবাকে কোর্টে তোলা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আদালতকে আমরা জানিয়েছি গত ১৭ জুলাই আমার খালু মারা যান। সে কারণে পরের দিন ১৮ জুলাই বাবা ভোলায় যান। পরে কারফিউ শুরু হয়ে যাওয়াতে বাবা ঢাকায় আসতে পারছিলেন না। শেষে ২৫ জুলাই ঢাকায় ফেরেন। আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তারপর শুনানির দিন খালুর মৃত্যু সনদ আদালতে দাখিল করতে বলেছেন। আমরা সেদিন তা আদালতে দাখিল করব। কিন্তু এর মধ্যে বয়স্ক একজন মানুষ যে রিমান্ডে থাকবেন, এই নিয়ে আমরা পুরো পরিবার শঙ্কিত।’
আদালতে এদিন হাজির করা হয় আরেক আসামির বাবা আবুল কালামকে। বললেন, ‘ঢাকায় আইলাম ডাক্তার দেহাইতে। আমার তলপ্যাডে (তল পেটে) বহুত দিন ধইরা ব্যথা। পোলায় আমারে নিয়া আইসে ঢাকায়। ডাক্তার দ্যাহাইছি। দ্যাশে (গ্রামের বাড়ি) চইলা যামু। কিন্তু গণ্ডগোলের (কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীতে সহিংসতা) কারণে যাইতে পারি নাই। আছি মোহাম্মদপুরে আমার হমন্দির (স্ত্রীর বড় ভাই) বাসায়। এর মইধ্যে আমার ছেলেডারে (আবদুস সোবহান) পুলিশ রাস্তা থেইকা ধইরা নিয়া গ্যাছে। তিন দিনের রিমান্ড শ্যাষ অইছে আইজ। এই জন্য কোর্টে আইলাম। জানি না পোলার কপালে কী আছে!’
আরেক আসামির মা মোবাশ্বেরা খাতুন বলেন, আমার ছেলে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো চাকরি করে। পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে। আইনজীবী বললেন, এখন নাকি রাজনৈতিক মামলায় কাউকেই জামিন দিচ্ছে না।
আলাপচারিতায় শামিল হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কফিল উদ্দিন বললেন, জামিন পাওয়ার পর আসবে আরেক ধাক্কা। চাকরিতে আবার জয়েন করতে পারবে কি না। না কি অফিস তাকে অনিরাপদ মনে করে চাকরি থেকে বিদায় দিয়ে দেয়।
আরেক স্বজন বললেন, যদি চাকরিতে জয়েন করতে পারেনও, অফিস সহকর্মীরা হয়তো তাকে কোনো একটা দলের সমর্থক মনে করবেন। তাতে ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি থাকবে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতার ঘটনার বিভিন্ন মামলায় গতকাল বুধবার সিএমএম আদালত আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ ১২ জনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এদিন মোট ১৩৫ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে আদালত ছেড়ে দেন। বাকি ১১৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। সিএমএম আদালতে দায়িত্বরত পুলিশের ওসি (হাজত) মুরাদ হোসেন গতরাত সাড়ে সাতটার দিকে খবরের কাগজকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডি থানার মামলায় মঞ্জুরের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত পুলিশের আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতায় রাজধানীর বনানীতে সরকারি স্থাপনা সেতু ভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল হাসানাত ডেভিডের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় গতকাল বুধবার সারা দেশে দুই শতাধিক সন্দেহভাজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে।