চলমান আন্দোলন ও সহিংসতায় প্রবাসীদের অনেকেই রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধের ডাক দিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে ডলার বাজারে। বিনিময় হার আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। জুলাই মাসের ১৯ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত সময়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহে একধরনের স্থবিরতা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ওই ৯ দিনে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৫-১৬ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিন গড়ে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৮ কোটি ডলার।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশে বিরাজমান আন্দোলন-সহিংসতার পরিস্থিতিতে প্রবাসীরাও উদ্বিগ্ন। সরকারকে চাপে ফেলতে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধের ডাক দিয়েছেন প্রবাসীদের একটি অংশ। রেমিট্যান্সপ্রবাহে স্বাভাবিক গতি ফেরাতে হলে তাই প্রবাসীদের আস্থা তৈরি করতে হবে।
ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্টের (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী দেশের প্রায় দেড় কোটি বা ১৫ মিলিয়ন নাগরিক প্রবাসে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এর মধ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেই রয়েছেন এক কোটিরও বেশি। এর বাইরে উচ্চ আয়ের প্রবাসী রয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়।
গত ১৯ জুলাই থেকে দেশে কোটা প্রথার সংস্কার চেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে প্রবাসীদের একটি অংশ রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করার মাধ্যমে সরকারকে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে বৈদেশিক আয়ের একটি বড় অংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) রেমিট্যান্স আসে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। আগের দুই অর্থবছরে (২০২২-২৩ এবং ২০২১-২২) দেশে রেমিট্যান্স আসে যথাক্রমে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ও ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। দেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান প্রায় ৫ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স একদিকে আমদানি ব্যয় নির্বাহে কাজে লাগে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে ও তা স্থিতিশীল রাখতে কাজে লাগে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে দেশের বাজারে ডলারের সরবরাহ ও এর বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসীরাও উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে একটি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ পরিস্থিতির উন্নতি দরকার। তা না হলে রেমিট্যান্সের এই পতন হয়তো ঠেকানো যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য যে কারণগুলো আমরা দেখি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে, যেমন হুন্ডি... সেগুলো আগেও ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও হয়তো থাকবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট আস্থাহীনতা।’
দুই বছর ধরেই বাংলাদেশ ডলারসংকটে ভুগছে। এ সংকট নিরসনে নানা পদক্ষেপ নিয়েও কাজ না হলে গত মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর নির্ধারণ করতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে। ওই মাসেই প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ে।
ক্রলিং পেগ পদ্ধতির সূচনা করার মাধ্যমে ডলারের দর বাজারমুখী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারে তখনকার বিনিময় মূল্য ১১০ টাকা থেকে এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে দেয়। দর বৃদ্ধির ফলে প্রবাসীরা রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের দর পাচ্ছেন ১১৭ টাকার সঙ্গে বাড়তি আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা। এতে ব্যাংকিং ও এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে প্রেরিত প্রতি ডলারের দর পড়ছে ১২০ টাকার মতো। ফলে বৃদ্ধি পায় রেমিট্যান্সপ্রবাহ। মে-জুন মাসের রেমিট্যান্সের তথ্যও এর প্রমাণ দেয়। জুন মাসে এককভাবে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন বা ২৫৪ কোটি মার্কিন ডলার দেশে আসে। মে মাসে এসেছে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন বা ২২৫ কোটি ডলার।
বৈদেশিক খাতের চরম অস্থিতিশীলতার এ দুঃসময়ে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একধরনের ইঙ্গিত দেয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ দাবির পক্ষে মত ব্যক্ত করেন।
কিন্তু মধ্য জুলাই থেকে ঢাকাসহ দেশব্যাপী শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নিলে তা প্রতিরোধে সরকারের দেওয়া সাধারণ ছুটি ও কারফিউয়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের একটি পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করার মাধ্যমে সরকারকে অসহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়।
পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের কথায় কান না দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকেও রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি জোর আহ্বান জানানো হয়েছে।