‘একটা ভাত মাটিতে পড়লে পিঁপড়ার দল যেমন ঘিরে ধরে ঠিক তেমন করে ওই পশুরা আমার ওপর হামলে পড়েছিল। বেঁচে ফিরতে পারবো ভাবিনি। এখনো চোখ বন্ধ করলেই সেই লোকগুলোর নোংরামির দৃশ্য ভেসে ওঠে, ঘুমাতে পারি না।’
এমন বর্বরতার বর্ণনা দিলেন যৌন হেনস্তার শিকার নারায়ণগঞ্জের এক নারী সাংবাদিক। গত ২০ জুলাই সাইনবোর্ড এলাকার পাসপোর্ট অফিস মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের নিপীড়নের শিকার হন তিনি।
যৌন হেনস্তার শিকার ওই সাংবাদিক নিরাপত্তার ভয়ে এখনো মামলা করতে পারেননি। তার অভিযোগ, হামলাকারীরা নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, ফতুল্লা থানার বিএনপি সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটু ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি কাউন্সিলর ইকবালের লোকজন। ঘটনার পর তার মামলা নিতে যাওয়া পুলিশের কাছে তিনি এসব অভিযোগ করেন। জানা গেছে, ঘটনার পর কাউন্সিলর ইকবাল ও টিটুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভুক্তভোগী নারীর দাবি, ওই কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনায় জড়িতদের পুলিশ চিহ্নিত করতে পারবে।
কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত্র জানতে চাইলে ভিক্টিম বলেন, ‘সেই দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাইনবোর্ড এলাকার পাসপোর্ট অফিস মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তুলতে যাই। সঙ্গে ছিলেন আরও ২ পত্রিকার ২ নারী সাংবাদিক। আমরা সেখানে যাওয়া মাত্রই বিক্ষোভকারীরা আমাদের ঘিরে ধরে। সে সময় আমার সঙ্গে থাকা ওই দুজনকে কয়েকজন অন্যদিকে নিয়ে গেল। কয়েকজন আমার দিকে এগিয়ে প্রশ্ন করলে বলি, আমি সাংবাদিক। কথা শেষ না হতেই তারা আমাকে কিল-ঘুষি ও লাথি মারতে শুরু করে। আমার মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। একপর্যায়ে ব্যাগটা দে বলেই আমার ওপর হামলে পড়ে। কেউ আমার চুল টেনে ধরে, পরনের জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলে। আর আমি আতঙ্কে নিজের ব্যাগটা দুহাতে সামনে চেপে ধরে শরীর ঢাকার চেষ্টা করি। তখন শয়তানগুলো আমার মুখমণ্ডল দুই হাত ও শরীরে লাইটার জ্বালিয়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিতে থাকে- অন্যদিকে বাকিরা যে যেভাবে পারে সারা শরীরে নির্যাতন চালিয়েছে। আমি অসহায়ের মতো শুধু মিনতি করেছি- ছাড়ুন আমাকে, যেতে দিন! আমি কিছু লিখব না, ছবিও তুলব না। অথচ কেউ আমার আকুতি শোনেনি। আশপাশের বিল্ডিং ও সেখানকার অনেক লোক এ অবস্থা দেখেছে- কেউ কেউ ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে। অথচ ভয়ে আমাকে সেফ করতে আসেনি। আমি শুধু বাঁচার চেষ্টা করছিলাম। একপর্যায়ে, প্রায় ১০ মিনিট পর ওই স্থানে আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়া শুরু হলে ওরা ভয় পেয়ে যায়, এরপর আমাকে ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।’
এরপর কী হলো? তিনি বলেন, ‘সে সময় স্থানীয় অনেকে ভেবেছিল আমি হয়তো মরে গেছি। আন্দোলনকারীরা সরে যাওয়ার পর আশপাশের কিছু লোক এসে আমাকে তুলে নেয়। সে সময় তাদের সঙ্গে কাউন্সিলর ইকবালও এগিয়ে আসেন। আমাকে তারা একজনকে দিয়ে অটোরিকশায় তুলে দেন। প্রথমে আমাকে স্থানীয় খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে দেখার পর ভর্তি না রেখে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু ফের হামলার ভয়ে আমি সেখানে না গিয়ে বাসায় চলে যাই। সেই সময় বাসায় স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান, আমার পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক নেতাসহ অনেকে দেখতে আসেন। শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় তাদের সহযোগিতায় হেল্থ রিসোর্স ক্লিনিকে ভর্তি করে আমার পরিবার। সেখানে ১১ দিন থাকার পর গত বৃহস্পতিবার আমি নিজের বাসায় না গিয়ে নিতাইগঞ্জে বড় ভাইয়ের বাসায় আসি।’
আক্রমণকারীদের আপনি কি চিনতে পেরেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি অনেককেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু তাদের নাম আমি বলতে চাই না। শুধু জানাতে চাই তারা বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোক। আমি আগেও ওই দলটির বিভিন্ন প্রোগ্রাম কভার করেছি। তারা অনেকেই আমাকে চিনেন, অথচ রক্ষা করেননি। বিশেষ করে ওই ঘটনায় আমাকে সেফ করার নাটক করা স্থানীয় কাউন্সিলর বিএনপি নেতা ইকবাল (সিদ্ধিরগঞ্জের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর) সে সময় ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি নিজেও আমাকে বলেছেন, ‘আমি তোকে পেছন থেকে ব্যাগ দিতে বলেছিলাম দিলি না কেন? অথচ আমি সেই ব্যাগ দিয়ে নিজের শরীর ঢাকার চেষ্টা করেছি। সে দিনের আন্দোলনের নেতৃত্বেও তিনি ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, কাউন্সিলর ইকবাল চাইলে আমাকে সেফ করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। ওই সময় সেখানে হেলিকপ্টারটি না এলে ওরা আমাকে মেরেই ফেলত।’
চিনতে পেরেছেন তার পরও মামলা কেন করলেন না? এমন প্রশ্নে ওই নারী সাংবাদিক বলেন, ‘আমি সম্মান হারিয়েছি, তার পরও বাদী হয়ে মামলা করতে চাই না। ভয় ও আতঙ্কে আছি। প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসনের কাছে আমি জীবনের নিরাপত্তা, সন্তান ও পরিবারের নিরাপত্তা চাই। ওই নরপশুদের বিচার চাই। যাতে আর কোনো নারীর ওপর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’
এ বিষয়ে ভিক্টিমের বড় ভাই বলেন, ‘সাংবাদিকতা তো কোনো অপরাধ নয়, মহান পেশা। সংবাদ সংগ্রহের কাজে গিয়ে বোনটি আমার যেভাবে নির্যাতনের শিকার হলো। এতে আমরা আতঙ্কিত। ফলে মামলা করারও সাহস পাচ্ছি না। তবে তার পাশে আছি। আমার মনে হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে দুর্বৃত্তরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও দেশবাসীর কাছে ওই পশুদের বিচার চাই। ঘটনা দ্রুত তদন্ত ও জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাই।’