শনিবার বেলা প্রায় ২টা। ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের নিচতলায় জনাবিশেক মানুষের জটলা। জটলা না বলে অপেক্ষা বলাই যথাযথ। কারণ বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তারা বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করছেন। বৃষ্টি কমলে তারা বের হবেন। অপেক্ষমাণদের কেউ আইনজীবী, কেউ আইনজীবীর সহকারী, আছেন বিচারপ্রার্থীও। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হলেও সবারই আলোচনার বিষয় প্রায় এক, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে শুরু হওয়া দেশব্যাপী চলমান সংঘাত-সংকট।
উপস্থিত বিচারপ্রার্থীদের একজন ফাহিমা আক্তার। সমিতি ভবনে এসেছেন আইনজীবীর চেম্বারে। দৈনিক খবরের কাগজকে জানান, তার ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দায়ের করা এক মামলায় পুলিশ তাকে আসামি করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার জামিন (এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের) হয়েছে ঠিক আছে। বেরিয়েও আসবে হয়তো। কিন্তু মামলা তো রয়েই গেল! মামলা মাথায় নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হবে। তাহলে কী সে পরীক্ষায় ফুল কনসেন্ট্রেশন দিতে পারবে? এখন আসলাম আইনজীবীর পরামর্শ চাইতে যে, মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়া যায় কি না।’
আলাপচারিতায় যুক্ত হয়ে এক আইনজীবী হুমায়ুন কবির বললেন, ‘এটা আলাদাভাবে কিছু হবে না। ওপর থেকে (সরকারিভাবে) যদি সিদ্ধান্ত না হয়, হবে না। যেমন: সরকার বলেছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জামিনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে, তারপর তাদের জামিন হয়েছে।’
আরেক অভিভাবক ইমতিয়াজ হোসেন বললেন, ‘শুধু পরীক্ষার সময় না, পরীক্ষার পরও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সঙ্গে পরীক্ষা এবং ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি, দুটিই তাদের সারা জীবনের ওপর প্রভাব রাখবে। মাথার ওপর মামলা থাকলে কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারবে না। তাই বিষয়টি সবার ভাবা-বোঝা দরকার। এটা তাদের সারা জীবনের বিষয়।’
এদিকে শনিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে (সিএমএম) ৭০ জন আসামিকে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে ২-৩ জনকে রিমান্ডে পাঠানো হয়। অন্যদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এই আদালতে দায়িত্বরত পুলিশের ওসি (হাজত) মুরাদ হোসেন গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। একই মামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে এখনো আদালতের কার্যক্রম চলছে।’
তাদের মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর রামপুরায় সরকারি স্থাপনা বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ তিনজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। অন্য দুই আসামি হলেন গোলাম দস্তগীর প্রিন্স ও এ বি এম খালিদ হাসান। পুলিশের আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
সরকারি আরেক স্থাপনা সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বনানী থানার মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শান্ত ইসলাম মল্লিকের আদালত তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে এই আদেশ দেন।
একই ঘটনায় করা মামলায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। তাদের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আরিফ সোহেল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। জাতীয় যে সমন্বয়ক কমিটি আছে, আমি সেখানেও আছি। কোটা সংস্কারের দাবিতে একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেছিলাম। সেখানে সন্ত্রাসী বাহিনীসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা হামলা করায় আমরা তার বিচার চেয়েও আন্দোলন চালিয়ে গেছি। আমরা বলেছি, শহিদদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আমরা আন্দোলন বন্ধ করতে পারি না।’
আরিফ সোহেল বলেন, ‘আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগানে ভাড়া বাসায় থাকি। সেখান থেকে গভীর রাতে কিছু লোক এসে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। তারা ডিবি হিসেবে পরিচয় দেয়। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে নিয়ে আসে। পরে আমি দেখতে পাই, আমার নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকি। সেখানে থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করে আসছি সমন্বয়ক হিসেবে। অথচ আমাকে বনানীর সেতু ভবন ভাঙচুরের একটা মিথ্যা মামলায় আমার নামে দেওয়া হয়। অথচ সেখানে আমি শেষ কবে গিয়েছি বা গিয়েছি কি না, বলতে পারি না। সেতু ভবন ভাঙচুরের মামলায় আমাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। রিমান্ড শেষে এখন আমি জামিন পেয়েছি আপনাদের সবার সমর্থনে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে জামিন পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘একটা পরিষ্কার বার্তা জানিয়ে দিতে চাই, এসব হামলা, মামলা করে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। শহিদের যে রক্ত ঝরেছে, এর জবাব আমরা নেব। এর জন্য যারা দায়ী, তারা রাষ্ট্রের যে পর্যায়ের ব্যক্তি হোন না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আসতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে জনগণের কাছে। তার আগ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। যত হামলা-মামলা আসুক। আমরা সব ফেস করব। আমরা মরতে শিখে গেছি, শহিদ হতে শিখে গেছি। আমাদের আর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’
ঢাকায় ২৬ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন
এদিকে গতকাল ঢাকার আদালত থেকে আরও ২৬ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থী জামিন পেয়েছেন। গত রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের এ তথ্য জানিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইনি সহায়তায় তারা জামিন পেয়েছেন বলে জানান কর্মকর্তারা।
কোনো এইচএসসি পরীক্ষার্থী আটক থাকলে তাদের জন্য [email protected] তে তথ্য পাঠানোর অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, গতকাল গণভবনে পেশাজীবীদের সঙ্গে সভা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দোষ সব শিক্ষার্থীকে মুক্তি দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।