সকাল ১০টার আশপাশ, তখনো কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। আগুনের তাপ আর ছাই উড়ছে বাতাসে। এর মধ্যেই উৎসুক জনতা এসেছেন পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি দেখতে।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে এমনটাই দেখা যায়। একসময় এটি ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি ও বর্তমান পরিচয় ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ি। এটি শুধু একটি বাড়ি নয়, নানা ঘটনা-অঘটনের সাক্ষী হওয়া এই বাড়িটি এখন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে এখানেই বসবাস করেছেন। এ বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতিটি ধাপ। এ বাড়িতেই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, যেখানে দেশে না থাকায় ভাগ্যক্র বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে জাদুঘর হয়েও রক্ষা হয়নি বাড়িটি। এখন আগুনে পোড়া এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাড়িটি।
গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বিক্ষোভকারীরা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালান। ভবনের বাইরের প্রায় সব গ্লাস ভেঙে ফেলা হয়। ধ্বংস করা হয়েছে ভেতরের সবকিছু। পরে আগুন দেওয়া হয় এই বাড়িসহ এর আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে।
গতকাল সকালে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক উৎসাহী মানুষ ভবনটি দেখতে এসেছেন। সেখানে আসা অনেকে আগে কখনো এই বাড়িতে আসেননি, তাই দেখতে এসেছেন। কেউ আবার এসেছেন আগে যা দেখে গিয়েছিলেন তার তুলনায় বর্তমান অবস্থা কী তা দেখতে। আবার অনেকেই পোড়া ছাই আর ধ্বংসস্তূপ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন জাদুঘরে থাকা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঐতিহাসিক ছবি, বিভিন্ন নথি, বই, পোড়া আসবাবপত্র, তাদের ব্যবহৃত জিনিসসহ যা হাতের কাছে পাচ্ছেন সবকিছুই। শুরুতে সেখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী দেখা না গেলেও পরে ছাত্র ও সচেতন জনতার একটি দল এটি লুট হওয়া থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। শুরুর দিকে তারা বিক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে পড়লেও পরে ধীরে ধীরে সেখানে থাকা বইসহ অবশিষ্ট জিনিগুলো রক্ষার দায়িত্ব নেন।
১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন- এই সবগুলোর সঙ্গে মিশে আছে বাড়িটি। দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাড়ি। যে বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ছিল এই বাংলার মানুষ তাকে মারতে পারে না, সেই বাংলার মানুষই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতেই তিনিসহ তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই বাড়িটি সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যকেই এই বাড়িতে ঢুকতে দেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরলেও সেদিন তাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যসের জন্য দোয়া ও মিলাদ পড়েন তিনি। এর কিছুদিন পর হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটি নিলামে ওঠানো হয়। তৎকালীন প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় নিলামে চড়ানো হয় বাড়িটি। সেই টাকা পরিশোধ করে বাড়ি বুঝে পান শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালের জুন মাসের ১০ তারিখে বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন, ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। তবে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে যখন বাড়িটি বুঝে পান, তখনো এই বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছিল রক্তের ছাপ। শেখ হাসিনা পরম মমতায় নিজে এবং তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বাড়িটি পরিষ্কার করেন। জানা যায়, রাজধানীতে নিজেদের থাকার কোনো জায়গা না থাকলেও শেখ হাসিনা ও তার বোনের ইচ্ছানুযায়ী এই বাড়ি জাদুঘর করার সিদ্ধান্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাড়িটিকে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে গত ১৬ বছর নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে থাকা বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপ।