শুক্রবার (৯ আগস্ট)) বিকেল ৪টা, রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে বেশ যানজট। দূর থেকে শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। হঠাৎ একজন তরুণ বলে উঠলেন ‘এই অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্স, একটু চেক করে দেখ ইমার্জেন্সি কি না।’
তার কথায় সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে অন্য ছাত্র চলে গেল, জবাব এল ইমার্জেন্সি। মুহূর্তেই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে অন্য রুটের যানবাহন বন্ধ করে যেতে দেওয়া হলো সেটিকে। এটাই হচ্ছে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। যেখানে অন্য সময়ে গণমাধ্যমে খবর আসে ভিআইপির যাতায়াতে আটকে থাকা যানবাহনের চাপে অ্যাম্বুলেন্সে প্রাণ যায় রোগীদের।
দেশে গণ-অভুত্থান পরবর্তী সরকার পতনের পরদিন থেকে রাজধানীসহ দেশের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছু সময় পর থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন কিছু সচেতন মানুষও।
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এখন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে গ্রামপুলিশ ও আনসারসহ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাশাপাশি রাস্তার পরিচ্ছন্নতা এবং রাস্তার পাশের দেয়ালগুলোতে লেখা সরকারবিরোধী নানা স্লোগান মুছে আঁকা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নানা প্রতীকী চিত্র। তাদের এমন কাজকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন পথচারীরা।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে দেখা যায়, রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ফুটপাতে হাঁটা, নির্দিষ্ট স্থান থেকে গাড়িতে ওঠানামা ও নির্দিষ্ট লেন ব্যবহার করাতে জনসাধারণকে সচেতন ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর পান্থপথে অনেকের সঙ্গে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের শিক্ষার্থী মো. জাহিদ হোসেন।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখানে আমরা কয়েকটি লেন করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছি। এর মধ্যে ইউটার্ন ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য একটি লেন
যেমন আছে, আবার বামে যাওয়ার জন্য বামের আলাদা লেন আছে। এভাবে আমরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছি।’
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়া সেতু বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে। যাতে আমার দেশের মানুষের কোনো অসুবিধায় বা ভোগান্তিতে পড়তে না হয়। এ পরিস্থিতিতে যেন যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, এটা খুব প্রয়োজন। তাই আমি এসেছি।’ অন্যদিকে চল্লিশোর্ধ্ব শামিমা আক্তারও করছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ। তিনি বলেন, ‘আমি এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তখন থেকে আছি, যখন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো শুরু হয়। কারণ আমার মনে হয়েছে আমাদের সন্তানদের বুকে গুলি লাগার আগে আমাদের লাগুক। এখানে এসেছি ওদের সহযোগিতা করতে। ওরা যেভাবে কাজ করছে তার সঙ্গে আমিও একাত্ম হয়েছি।’
এদিকে কেবল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নয়, রাস্তা পরিষ্কারসহ আশপাশ ও ফুটপাতও পরিষ্কার করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ‘সবকিছুকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করতে দেখা যায় নুরুন্নাহার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ুয়া সাদিকুন রায়হান রাইসাসহ বেশ কয়েকজনকে। রাইসা বলেন, ‘আমরা কয়েকজন এখানে রাস্তা ও এর আশপাশ পরিষ্কার করছি। দেশপ্রেমের জায়গা থেকেই এসেছি। আমি কখনো ভাবিনি এভাবে দেশের সেবা করতে পারব। এখানে আমার অনেক বড় আপু ও ভাইয়ারাও কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে কাজ করছি, এটা খুব ভালো লাগছে।’
অন্যদিকে আন্দোলন চলাকালে রাস্তার পাশের বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালে সরকারবিরোধী যেসব স্লোগান লেখা হয়েছিল তাও মুছতেও কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়ক ও এর আশপাশের যেসব স্থাপনায় দেয়ালে স্লোগান লেখা হয়েছিল সেখানে পুনরায় সাদা রং করে আঁকা হচ্ছে আন্দোলনে শহিদ হওয়া ফায়াজসহ বিভিন্ন জনের ছবি। রং-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা সময়ের চিত্র।
শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পথচারীরা। গতকাল বিকেলে পান্থপথের একজন পথচারী রেজা করিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। তারা খুব সুশৃঙ্খলভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করছেন।’ রিকশাচালক মো. আলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেভাবে কাজ করছেন, আমি তাদের সঙ্গে আছি। আমি গোলাগুলির সময়ও তাদের সঙ্গে ছিলাম। তারা এখন যে কাজটা করছেন, এটা খুবই ভালো হচ্ছে।’
পালাক্রমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করছেন তাদের জন্য পানি-খাবার নিয়ে আসছেন সাধারণ জনতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায় থেকে ছাতা ও ক্যাপও দেওয়া হচ্ছে তাদের।