সরকার পরিবর্তনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। তারা বিভিন্ন বাজার মনিটরিং করছেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে পাইকারি পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা কমে ৯৫-১০০ টাকায় নেমেছে। কিন্তু এখনো খুচরা পর্যায়ে সেভাবে কমেনি। বিভিন্ন ছলছুতা দেখিয়ে খুচরা বিক্রেতারা ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি করছেন। আলুর দামও কমেনি। ৪৭ টাকার আলু ভোক্তাদের ৬০-৬৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
সোমবার (১২ আগস্ট) আড়তদার, ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর কৃষিপণ্যের আড়ত শ্যামবাজার কৃষিপণ্য মালিক সমিতির সহসভাপতি ও রাজবাড়ি ভাণ্ডারের মালিক আ. মাজেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্ররা পেঁয়াজ আলুর দাম কমাতে বলেছেন। তারা বলছেন, ৭০ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব। কারণ দাম তো বিভিন্ন মোকাম থেকে বেঁধে দেওয়া। ট্রাক ভাড়া, আড়তদারি ও লোড-আনলোড খরচ বাদে বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ ৯৫-১০০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৯০-৯৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এর চেয়ে কমার সম্ভাবনা কম। কারণ এ বছর প্রথম থেকেই পেঁয়াজের দাম বেশি। মোকাম থেকে দাম বেঁধে দেওয়া। আমরা শুধু কমিশন পাই। ১৫ দিন আগে এই পেঁয়াজ ছিল ৯০-৯৫ টাকা কেজি। মাসখানেক আগে ১১০ টাকা। এই বাজারে গড়ে বিভিন্ন মোকাম থেকে ৩০০ টন পেঁয়াজ আসে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়।’ কারওয়ান বাজারের আড়তদার মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের রাজিব বলেন, ‘বিভিন্ন মোকাম থেকে পেঁয়াজ আসছে। বর্তমানে ১০০-১০৩ টাকা কেজি। ১৫ দিন আগে তা ৯২-৯৭ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়। মাসখানেক আগে ১১০-১১৫ টাকা ছিল।’
বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ হয়েছে ২৫-৩০ টাকা। পাবনা জেলার কৃষক ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ী চোসাই বসু বলেন, ‘এবারে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালোই হয়েছে। কেজিতে খরচ পড়েছে ২৫-৩০ টাকা। ঢাকার আড়তে পাঠাতে পরিবহন খরচ পড়ে ৩ টাকা, আড়তে খরচ ১ টাকা থেকে ১ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন মোকামেই ৯০ টাকার ওপরে বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকার আড়তে তা ৯৫-১০৫ টাকা কেজি। খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের তা কিনতে হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়।’
দামের ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা এরশাদ, জসিমসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা বলেন, গতকাল ছাত্ররা বাজারে এসেছিলেন। তারা বলেছেন কম দামে বিক্রি করতে। কিন্তু ১০০ টাকার ওপরে কেনা। তাহলে কীভাবে ১০০ টাকার কমে বিক্রি করব। হাতিরপুল বাজারের আমির ও মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের মো. ওলিসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা বলেন, ‘মোকামে বেশি দাম। এ জন্য কমে না দাম। তা ১২০-১৩০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবিও বলছে, গত বছর এই সময়ে ৭৫-৮৫ টাকা বিক্রি করা হয়েছে। বর্তমানে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও ১১০-১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
এফবিসিসিআই সূত্র মতে, দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। উৎপাদন এর চেয়ে বেশি ৩৭ লাখ টন হয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষতি হয়। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় ৬-৭ লাখ টন। তার পরও দাম বেশি। ভোক্তাদের বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।
পেঁয়াজের মতোই আলুর দশা দেখা গেছে বাজারে। কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের মালিক সবুজ বলেন, ‘ছাত্ররা বাজারে এসেছিলেন। তারা বলে গেছেন ৪০ টাকা কেজি বিক্রি করতে। কিন্তু এটা সম্ভব না। কারণ ট্রাক ভাড়া, কমিশন লোড-আনলোড খরচ ধরে মুন্সীগঞ্জের আলু ৪৮ টাকা ও রাজশাহীরটা ৫২ টাকা কেজি পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। এর কমে বিক্রি করতে চাইলে মোকামে ধরতে হবে। সেখানে কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারব।’
কিন্তু এই বাজারের একটু দূরে দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতারা তা ৬০-৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন। রাকিব নামে এক খুচরা বিক্রেতা বলেন, ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের আলু বিক্রেতা রফিকও জানান, আড়তে বেশি দামে কেনা। তাই ৬০-৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। হাতিরপুল বাজারের খুরশেদসহ অন্য বাজারের খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, ৬০-৬৫ টাকা কেজি আলু।
কৃষকরা জানান, এবার চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ১৭-১৮ টাকা কেজি। হিমাগার রাখতে কেজিতে ভাড়া লাগে ৫ টাকা। ঢাকার আড়তে পৌঁছাতে পরিবহন খরচ হয় দেড় টাকা। আড়তদারি দিতে হয় আরও ১ টাকা। মধ্যস্বত্বভোগীরা সেই আলু হিমাগার গেটেই দ্বিগুণ দামে ৪৫-৪৮ টাকা কেজি বিক্রি করছেন। আড়তে আরও বেশি দামে ৪৮-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা কেজি।
আলুর বাড়তি দামের ব্যাপারে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এফবিসিসিআইএর সাবেক সহসভাপতি মোস্তাফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে আলু ভালোই উৎপাদন হয়েছে। তাই সব খরচ মিলে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫-৩৭ টাকার বেশি আলুর কেজি হওয়ার কথা নয়। সারা দেশে ৩৬০টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে অনেক কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা আলু রেখেছেন। বর্তমানে হিমাগারেই ৪৫-৪৮ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।