শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর দেশব্যাপী শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়েও।
সোমবার (১২ আগস্ট) সকালে ইসি ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ফ্লোরে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। নিয়মিত অফিস করলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও নেই আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কমিশনাররা কবে কখন পদত্যাগ করবেন, কোন কর্মকর্তাকে কোথায় বদলি করা হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কক্ষে প্রায় ২ ঘণ্টা বৈঠক করেন সচিব শফিউল আজিমসহ চার নির্বাচন কমিশনার। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিইসিসহ কমিশনাররাও নিচ্ছেন মানসিক প্রস্তুতি। চলমান প্রেক্ষাপটে আগামীতে কমিশনের নেতৃত্বে কারা আসবেন, কবে নাগাদ গঠিত হবে সেই কমিশন, তা নিয়ে চলছে কানাঘুষা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থেকেই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদত্যাগ করছেন। ঊর্ধ্বতনদের অনেকে বরখাস্তও হচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তাদের রদবদল করা হচ্ছে। রবিবার ১১ আগস্ট জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ইসির চার উপসচিব পদে রদবদল করা হয়েছে। তাতে নির্বাচন পরিচালনা শাখায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, রাঙামাটির সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনির হোসেনকে উপসচিব হিসেবে নির্বাচন পরিচালনা-২ শাখায় বদলি করা হয়েছে। আর নির্বাচন পরিচালনা-২ শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমানকে দেওয়া হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা-১ অধিশাখার দায়িত্ব। আর নির্বাচন পরিচালনা-১ শাখার উপসচিব এম মাজহারুল ইসলামকে বদলি করে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কল্যাণ শাখায় উপসচিব করা হয়েছে। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কল্যাণ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ নুরুল আলমকে বদলি করে রাঙামাটির সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা করা হয়েছে।
৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেদিন প্রথম কার্যদিবসে ও তার পরদিনও অফিস করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। অন্য চার নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা, আহসান হাবীব খান, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমানও ৬ আগস্ট অফিস করেননি। তবে ৭ আগস্ট অফিস করেছিলেন দুই নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান ও মো. আলমগীর। এ ছাড়া প্রথম দুই দিন ইসির অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও অফিস করেননি।
গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার পর থেকে সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত বিএমডব্লিউ গাড়ি সরিয়ে নিয়ে তাদের দেওয়া হয়েছে পাজেরো গাড়ি। ওই দিন অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সিইসিসহ বাকি চার কমিশনার। কিন্তু নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বঙ্গভবনে যেতে পারেননি কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ চার নির্বাচন কমিশনার।
অন্যদিকে ৮ আগস্ট দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে ইসি সচিবালয়ের মূল গেটের দুই পাশে ব্যানার টানান বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। ওই ব্যানারে লেখা রয়েছে- ‘বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা হত্যা এবং গণহত্যার দায়ে সকল নির্বাচন কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে’ ছাত্র-জনতা। তার পর থেকে হাবিবুল আউয়াল কমিশনের পদত্যাগ নিয়েও চলছে গুঞ্জন।
বাংলাদেশের সংবিধান (১১৮ অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতির আদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত। আর রাষ্ট্রের যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় অথবা রাষ্ট্রপতির আদেশে পদত্যাগ করবেন। নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ এসব পদে কার্যকালের মেয়াদ তাদের কার্যভার গ্রহণের দিন থেকে পাঁচ বছর।
হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন দেশের ১৩তম নির্বাচন কমিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। তাদের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত ৭ জানুয়ারি এই কমিশনের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সরকার।