নবনিযুক্ত গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রথম দাপ্তরিক বৈঠকে বলেছেন, নতুন করে আর কোনো ভুল করা যাবে না। অতীতের সব ভুল খতিয়ে দেখে তাতে কার দায় ছিল, তা খুঁজে বের করতে হবে। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পালন করবে। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রচলিত সব বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ করা হবে। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ওই বৈঠক করেন। এতে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার ও হাবিবুর রহমানসহ নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ওই বৈঠকে যোগ দেন।
সভার শুরুতে কর্মকর্তারা নতুন গভর্নরকে স্বাগত জানান। পরিচয়পর্ব শেষে কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও পতিত সরকারের মেয়াদে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে ধারণা দেন। কর্মকর্তারা নতুন গভর্নরকে জানান যে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে চান। তারা এ সময় ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকের মেয়াদসহ কতিপয় আইনগত সংশোধনীর পরিবর্তন প্রয়োজন বলেও মত প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, গতকাল বৃহস্পতিবারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নতুন গভর্নর প্রথম বৈঠক করেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৯ আগস্ট পদত্যাগ করলে অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৩ আগস্ট নতুন গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগ দেয়। পরদিন বুধবার নতুন গভর্নর হিসেবে ড. মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেন। একই দিনে তিনি তার দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন এবং পরে সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা শেয়ার করা নিয়ে প্রথম দিন ব্যস্ত সময় পার করেন।
বিগত সরকারের তিন মেয়াদে দেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এ সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া কাগজপত্রে নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রয়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ফলে ওইসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট তৈরি হয়। এ কারণে একাধিক ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার পরিণতিতে ধার করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বেশ কিছু ব্যাংক।
মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অনাদায়ী ঋণের অর্থ উদ্ধারে ৭২ হাজার মামলা অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় আটকে আছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ১২ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকিং খাতের চিত্র তুলে ধরে জানায়, দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে আটকে আছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। সিপিডির পক্ষ থেকে ওই অর্থ আদায়ে অর্থঋণ আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তিরও আহ্বান জানানো হয়।
বিগত সময়ে নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। তার প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। কিন্তু সরকার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষম হয়নি।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতাও মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতন ঠেকানোই যাচ্ছিল না। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের হিসাবে গরমিল ছিল সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি আয়ের হিসাব থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে সংশোধিত তথ্য প্রকাশ করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও নতুন গভর্নর ড. মনসুর দুজনই তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, আর্থিক খাতের সংস্কার করার মাধ্যমে ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।