হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অ্যাডভোকেট আবু জাহির। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনি হবিগঞ্জজুড়ে কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগকে ‘পারিবার লীগে’ পরিণত করা, নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন নেওয়া, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ ঘুষ-বাণিজ্য, শিল্পাঞ্চলে একক অধিপত্য বিস্তার, ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানাধীন জমি-বাড়ি দখল করাসহ অর্থনৈতিক এমন কোনো খাত নেই, যেখানে আবু জাহিরের হাত ছিল না। এ ছাড়া আবু জাহির নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাগনে আতাউর রহমান সেলিমকে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র, শ্যালক কামরুজ্জামান আল বশিরকে বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউপির চেয়ারম্যান এবং চাচাতো ভাই আবদুর রহিমকে রিচি ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। অতিসম্প্রতি তার অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আবু জাহিরের উত্থান
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের প্রবীণ রাজনীতিকদের তথ্যমতে, ছাত্র ইউনিয়নের হাত ধরে রাজনীতিতে পা রাখেন জাহির। তার কিছু দিন পর যোগ দেন ছাত্রলীগে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। একই সময় তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আর এখান থেকে আবু জাহিরের মূল উত্থান শুরু।
সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। এ সময় আবু জাহির গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর কপাল খুলে যায় তার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন আবু জাহির।
অবৈধ আয়েই ‘লাল’ জাহির
এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আবু জাহির ছিলেন আয়কর আইনজীবী। এ পেশার আয় দিয়ে তার সংসার চলত। ওই সময় হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের একটি টিনশেড বাসায় পরিবার নিয়ে তিনি ভাড়ায় থাকতেন। নিয়মিত বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। তবে এমপি হওয়ার পর যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান তিনি। শহরে গড়েছেন কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি। মালিক হয়েছেন আড়াইশ ভরি সোনার। সেই সঙ্গে ছিল একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন একাধিক জমি ও বাড়ি দখলের। এমনকি হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের কোয়ার্টার এবং মার্কেট তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সে সব দখল করে দিয়েছেন নিজের ভাইকে। এ ছাড়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনের পুকুরের ১৮ শতাংশ জমি স্ত্রীর নামে করে নিয়েছেন। এসব ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন, শহরে বিরোধপূর্ণ জমি-জমার মীমাংসায় কমিশন, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ ঘুষের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন জাহির। তা ছাড়া কেদারা কোর্ট এলাকায় শত কোটি টাকা মূল্যে স্ত্রী আলেয়া আক্তার, ছেলে ইফাদ জামিল, ভাই বদরুল আলম, ভাতিজা সাঈদুর রহমান এবং নিজের পিএস সুদ্বীপ দাসের নামে ২০০ শতাংশ জমি কিনে ছিলেন তিনি। পরে ওই এলাকায় বাল্লা স্থলবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে, সেই জমি তিনি চারগুণ মূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করেন। এ ছাড়া হবিগঞ্জ বিসিকে ছেলের নামে রয়েছে বিশাল প্লট। সেই সঙ্গে রাজউকেও প্লট রয়েছে আবু জাহিরের।
শিল্পাঞ্চলে আবু জাহিরের অধিপত্য
গত এক যুগে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক শিল্প কারখানা। সেখানেও ছিল আবু জাহিরের অধিপত্য। জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের কমিশন। তাকে কমিশন না দিয়ে এক বিঘা জমিও রেজিস্ট্রি করতে পারেনি কোনো কোম্পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিল্প কারখানার জমি কেনার সময় আবু জাহিরের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকত। তার কমিশন বুঝিয়ে না দেওয়ার আগে জমি রেজিস্ট্রি হতো না। এমনকি হবিগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় যত শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, সে সবের মালিকদের আবু জাহিরকে বিশেষ সুবিধা দিতে হতো। কেউ তাকে এড়িয়ে গেলে, কারখানা চালু হতে দেওয়া হতো না। এমন উদাহরণও অনেক আছে।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘শিল্প এলাকায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু এখানে কোনো শ্রমিক সংগঠন নেই। তাই শ্রমিকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কোম্পানিগুলো থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন আবু জাহির।’
বালু ও জলমহালে নিয়ন্ত্রণ
চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলার বিভিন্ন সরকারি বালুমহালে নিয়ন্ত্রণ ছিল জাহিরের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ভাই বদরুল আলমকে দিয়ে ইজারা নিতেন বালুমহাল। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে ইজারাবহির্ভূত স্থান থেকেও বালু উত্তোলন করত তার ভাই।
বাহুবলের অধিকাংশ টিলা সমতল ভূমিতে পরিণত
খোয়াই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে আবু জাহির জড়িত থাকায় নীরব ছিল প্রশাসন। একইভাবে জেলা তাঁতী লীগ সভাপতি মুদ্দত আলীকে দিয়ে বাহুবলের অধিকাংশ টিলার মাটি কেটে বিক্রি করেছেন। সাড়ে ১৫ বছরে সেগুলো সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
জলমহালে নিয়ন্ত্রণ
আওয়ামী লীগ নেতা ও লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিউল আলম আজাদকে দিয়ে জলমহাল নিয়ন্ত্রণে রেখে ছিলেন জাহির। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাখাই এলাকার একটি সমবায় সমিতির নেতা জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জলমহাল ইজারা নিতে হলে সমবায় সমিতির সনদ লাগে। যে কারণে এ এলাকার সমিতিগুলোকে কখনো হুমকি-ধমকি, কখনো কমিশনের মাধ্যমে সনদ নিয়ে জলমহাল ইজারা নিতেন মুশফিউল আলম। এতে সরাসরি জড়িত থাকতেন আবু জাহির।
স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য
জেলাজুড়ে ওপেন সিক্রেট, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানেই আবু জাহিরের পকেট গরম।’ এমপি থাকা অবস্থায় পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। জেলায় তার অপছন্দের ব্যক্তি পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার নজির খুব একটা নেই। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার পরও নির্বাচনে পল্টি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একজনকে মনোনয়ন দিয়ে, গোপনে গুজিবাজি করে বিজয়ি করেছেন অন্য প্রার্থীকে।
রাজনৈতিক দমন-পীড়ন
দমন-পীড়ন ছিল আবু জাহিরের প্রধান অস্ত্র। গত সাড়ে ১৫ বছরে তার দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন দলের নেতা-কর্মীসহ ভিন্ন মতের লোকজন। যারাই তার মতের বিরুদ্ধে গেছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়েছেন।
২০১৯ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে আবু জাহিরের বিপক্ষে থাকায় জেলা আওয়ামী লীগে ঠাঁই হয়নি তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, সাবেক নারী এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়াসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার। যদিও পরে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে বাদ দেওয়াদের কয়েকজনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আবু জাহিরের ছবি ওপরে না লাগিয়ে একটি শুভেচ্ছা পোস্টারও লাগাতে পারেননি আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী। যারা আবু জাহিরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। আবার তাকে হুজুর হুজুর করে অনেক বহিরাগতও জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন।’
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের মতো স্বৈরাচার দেখিনি। এই সাড়ে ১৫ বছরে তারা আমাদের সঙ্গে যা করেছে, তা ভোলার না। আমরা ভালোভাবে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করতে পারিনি। শারীরিকভাবে নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে আমাদের দমানো হয়েছে।’
হবিগঞ্জের সিনিয়র সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর হবিগঞ্জের মানুষ একটা আতঙ্কের মাঝেই ছিলেন। অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন, হয়রানি করেছেন আবু জাহির।’
আওয়ামী লীগকে ‘পারিবার লীগে’ পরিণত
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব ছিল জাহিরের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের হাতে। আবু জাহিরের স্ত্রী জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক, বছরের পর বছর দেশের বাইরে থাকা ছেলে ইফাত জামিল জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভাই বদরুল আলম জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভাতিজা ফয়জুর রহমান জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ভাতিজা সাঈদুর ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের বিগত কমিটির সভাপতি।
দুদকের অনুসন্ধান শুরু
জাহিরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তথ্যানুসন্ধানকালে তার নিজ নামে ব্যাংকে নগদ টাকা, সঞ্চয়পত্র, রাজউকে প্লট, স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, ‘মানুষ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন কিছু চাটুকার তৈরি হয়। এই চাটুকাররা ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে এমনভাবে বুঝায়, ‘যে তার ক্ষমতা পৃথিবী জুড়ে।’ ফলে চেয়ারে যিনি থাকেন, তারও একটা ভাব হয় যে আমিই সব। এই অহংকারের জন্য জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর প্রতিফলনই এবার আমরা দেখলাম।’