
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বাবর রোডের তিনতলা ফ্ল্যাটটি টাকা রাখার গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তিন কোটি টাকা উদ্ধারের পর ফ্ল্যাটটি সিলগালা করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে গত শনিবার রাতে রাজধানীর মহাখালীতে অভিযান চালিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। শাহ কামাল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মহাখালীতে একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছে ডিবি। এদিকে এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাবর রোডের এই ফ্ল্যাটে ছিল শত কোটি টাকা। সোর্সের মাধ্যমে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য কয়েক মাস আগেই পেয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে বিভিন্ন জটিলতার কারণে সেই সময় অভিযান চালায়নি সিআইডি। এরপর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই শাহ কামালের বাড়ির সব ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা খুলে ফেলা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে কালো গ্লাসের গাড়িতে মালামালভর্তি বস্তা বের করে নিয়ে যেতে দেখেছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে রবিবার (১৮ আগস্ট) বাবর রোডের এফ ব্লকের ২৯/২ ও ৩ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দুটি গেটই বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ফ্ল্যাটটি সিলগালা করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাড়ির পার্কিংয়ে বেশ কয়েকটি কালো রঙের জিপ গাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া গেটে দারোয়ানদের সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে। এ ছাড়া তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটির ব্যালকনির দরজাও বন্ধ দেখা যায়। তবে গত পরশু রাতে তার গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ওই বাসার সামনে সাধারণ মানুষকে জটলা, কানাঘুষা ও হাসাহাসি করতে দেখা যায়। এ ছাড়া কয়েক বস্তা টাকা উদ্ধার ও গ্রেপ্তারের ঘটনার পর এলাকায় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাত- সব জায়গাতেই এখন আলোচনায় শাহ কামালের টাকার বস্তা।
বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জহির মোল্লা বস্তির তফুরা বেগম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বাড়িতে নাকি টাকার বস্তা পাওয়া গেছে। আবার শুনলাম ধরাও খাইছে, তাই দেখতে আইছি।’
স্থানীয়রা জানান, গত শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই ফ্ল্যাটে কাউন্টার টেররিজমের (সিটিটিসি) ডিসি ও দুদকের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি অভিযান চালান। এ সময় বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে এলে তারা সেনাবাহিনীতে ফোন করে বিষয়টি জানান। এরপর ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ আসে। এর আগেই কয়েক ব্যক্তি কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত গাড়িযোগে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। এ ছাড়া সাবেক এই সচিবের বাড়ির মধ্যে সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তির ফ্ল্যাট রয়েছে। যারা নিয়মিত এ বাড়িতে যাতায়াত করেন বলে জানান তারা।
বাড়িটির ভেতরে পার্কিংয়ে কথা হয় বাড়ির ম্যানেজার হুমায়ুনের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি অনেক ভিআইপি কালো গ্লাসের গাড়িতে আসতেন। তাদের মেহমান হিসেবে সম্মান দিয়ে ফ্ল্যাটে দিয়ে আসা হতো। গাড়িতে করে কে কী আনতেন সেটা বলতে পারব না। বাসায় যেদিন পুলিশের লোক এসে অভিযান চালায় ওই দিনই আমরা প্রথম জানতে পারি। এর আগে বুঝতে পারিনি।’
তিনি বলেন, স্যার (শাহ কামাল) সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। বকশিশও দিতেন মোটা অঙ্কের।
ওই বাড়িটির বিপরীত পাশে আছে তিতাস জেনারেল স্টোর নামে একটি মুদি দোকান। দোকানের মালিক সামসুল ইসলাম সাচ্চু খবরের কাগজকে বলেন, ‘১৩ আগস্ট আমার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। তিনি নিজেই দোকানে আসতেন বিভিন্ন জিনিস কিনতেন। কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি তিনি একটা চোর ও ঘুষখোর।’
তিনি বলেন, ‘শাহ কামাল এই ফ্ল্যাটে থাকতেন না। এখানে তিনি তার প্রয়োজনীয় জিনিপত্র রাখতেন। এক দিন জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনাকে তো প্রতিদিন দেখি না। উত্তরে তিনি জানান, পাশেই আরেকটি বাসা আছে, সেখানে থাকি। এটা কাজের প্রয়োজনে নিয়েছি।’
সাচ্চু আরও জানান, সন্ধ্যার পর থেকে এই ফ্ল্যাটে কালো গ্লাসের গাড়িতে অনেক লোকজন আসতে দেখেছেন তিনি। তবে শাহ কামালের চলাফেরা সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। তাই বোঝার উপায় ছিল না তিনি এত টাকার মালিক। ফ্ল্যাটটি ছিল রহস্যে ঘেরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের নতুন কমিশনার মো. মাইনুল হাসান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাবেক ওই সচিবের বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ৩ কোটি টাকা ও ১০ লাখ টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে পুলিশ। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। অপরাধ করলে ছাড় নয়।
গত ১৬ আগস্ট সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামালের বাসা থেকে নগদ ৩ কোটির বেশি টাকা এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। শাহ কামাল ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। এ দায়িত্বে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে বদলি, কেনাকাটা, উন্নয়ন কাজসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধ অর্থ গ্রহণের অভিযোগ ছিল। শাহ কামাল ২০২০ সালের ২৯ জুন সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আইনগত ব্যবস্থা নেবে দুদক
সাবেক সচিব শাহ কামালের বিষয়ে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানিয়েছে দুদক। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) টাকা উদ্ধার ও অভিযানের বিষয়টি দুদকে জানালে তারা সহযোগিতা করতে সম্মত হয় ও ঘটনাস্থলে যায়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুদক জানায়, আমরা ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে। আমরা ভেতরে গিয়ে দেখি জব্দ করা টাকার ইনভেন্টরি করার কাজ শুরু হয়েছে। পরে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করি। এ বিষয়ে তদন্ত করে শাহ কামালের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দুদক।