ঢাকা ২০ আশ্বিন ১৪৩১, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যশূণ্য নিরপেক্ষ শিক্ষক খুঁজতে গলদঘর্ম

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:২২ এএম
নিরপেক্ষ শিক্ষক খুঁজতে গলদঘর্ম

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগে ‘নিরপেক্ষ শিক্ষক’ খুঁজে বের করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গণহারে পদত্যাগ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ পদত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দলসমর্থিত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে বসানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের পক্ষ থেকে চাপ তৈরি করা হচ্ছে। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগতে পারে। ফলে খুব শিগগির স্বাভাবিক হচ্ছে না অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘আগে যে সুবিধা ছিল, বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের শিক্ষকদের একটা সংগঠন থাকে। সেখান থেকে টেনে একজনকে ভিসি বানিয়ে দেওয়া হতো। আমাদের ক্ষেত্রে তো সেই সুযোগ পাচ্ছি না। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষককে আমরা চিনি, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনিক দক্ষতার দিক থেকে যারা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, এরকম শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করছি।’ দ্রুত সময়ে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো দলীয়-সরকার না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সবার চাওয়া অনুযায়ী নিরপেক্ষ শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সেভাবে নিরপেক্ষ, যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যাদেরই পাওয়া যাচ্ছে, তারা দায়িত্ব নিতে সম্মত হচ্ছেন না। প্রস্তাবে যাদের নাম আসছে, তারা বিএনপি-সমর্থিত  সাদা দলের শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব খবরের কাগজকে বলেন, উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি। সময় লাগবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসাবে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। বেশ কয়েকটিতে এখনো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। সরকার পতনের পর ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদ ছেড়েছেন, যা মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশের বেশি। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকার দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য দ্রুতই নিয়োগ দিতে আগ্রহী। সে অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিভিন্ন পক্ষের তরফ থেকে নাম দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সাদা দলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকেও উপাচার্য পদ পেতে আগ্রহী কেউ কেউ। তবে সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলামকে নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। 

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের নাম প্রস্তাবিত হলেও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ধর্মীয় বিষয়সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট সামনে আসায় এটি নিয়ে সমালোচনা হয়। শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশের পক্ষ থেকে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের নাম এসেছে। তিনি বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপ-উপাচার্যের দায়িত্বে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ব্যানারে তাকে কোনো কার্যক্রমে দেখা যায়নি বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন। অন্যদের চেয়ে অধ্যাপক নিয়াজের অ্যাকাডেমিক প্রোফাইল সমৃদ্ধ বলে দাবি করা হচ্ছে।

সাদা দল সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হলে অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রাধ্যক্ষ, ডিন, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতিতে নেতৃত্বের বিষয়টি বড় ভূমিকা রাখে। একদম নতুন কেউ দায়িত্ব নিলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। 

শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, দলীয়ভাবে উপাচার্য নিয়োগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ছাত্র রাজনীতি চালু থাকবে। সে কারণে তারা নিরপেক্ষ উপাচার্য দেখতে চায়।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যশূন্য
পদত্যাগজনিত কারণে চার স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বাকৃবি, বুয়েট, ইবি, শাবিপ্রবি, খুবি, বিএসএমএমইউ, হাবিপ্রবি, মাভিপ্রবি, পবিপ্রবি, শেকৃবি, চুয়েট, কুয়েট, ডুয়েট, নোবিপ্রবি, জবি, কুবি, জাকাইনবি, সেকৃবি, যবিপ্রবি, পাবিপ্রবি, বেরোবি, বশেমুরবিপ্রবি, বশেফমুবিপ্রবি, ববি, রাবিপ্রবি, রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদশূন্য রয়েছে।

সাবেক এমপি শাহে আলমের শতকোটি টাকা আত্মসাৎ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩২ পিএম
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩২ পিএম
সাবেক এমপি শাহে আলমের শতকোটি টাকা আত্মসাৎ
বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম তালুকদার

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন শাহে আলম তালুকদার। নব্বইয়ের দশকে এরশাদ সরকার পতন আন্দোলনের রাজপথ কাঁপানো এই ছাত্রনেতা ২০১৮ সালে বরিশাল-২ (বানারীপাড়া ও উজিরপুর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দরিদ্রজন জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন তহবিল থেকে নেওয়া শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। 

বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য গত বছর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও করেছিল বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণের ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

এমপি হওয়ার পর ভাগ্যবদল
সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পদের তালিকায় শাহে আলম ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা মূল্যমানের একটি গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর অর্ধকোটি টাকা মূল্যমানের নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসেন শাহে আলম। এরপর বছর না যেতে তার গাড়িবহরে যুক্ত হয় ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো। শুল্কমুক্ত সুবিধায়ন আনা ওই গাড়ির তৎকালীন মূল্য ছিল প্রায় দুই কোটি টাকা। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘এমপি’ নামক আলাউদ্দিনের চেরাগের ঘষায় শাহে আলমের ভাঙা টিনের ঘরেরও পরিবর্তন আসে। বাবা সাইজুদ্দিনের জরাজীর্ণ টিনের ঘর ভেঙে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স বাড়ি। একই সময়ে ওই বাড়ির বিপরীতে থাকা তিন শতাংশ সরকারি খাস জমি দখল করে নির্মাণ করে ব্যক্তিগত বৈঠকখানা এবং নিজস্ব কর্মচারী ও ড্রাইভারদের জন্য দ্বিতল ভবন। সরকারি খাল দখল করে নির্মাণ করেন সীমানাপ্রাচীর। এ নিয়ে কয়েকবার উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের শতকোটি টাকা আত্মসাৎ
শাহে আলম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের মালিকানাধীন এসএম ফাউন্ডেশনের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প থেকে নেওয়া শতকোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু ঋণের অর্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। জনশ্রুতি রয়েছে, ওই টাকাসহ বিপুল পরিমাণের অর্থ তিনি কানাডায় পাচার করেছেন। সেখানে গড়ে তুলেছেন বাড়ি, কিনেছেন গাড়ি। কানাডায় শিক্ষা ভিসা নিয়ে তার দুই ছেলে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে তিনি সেখানে গিয়ে অবকাশকালীন পার করতে যেতেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহে আলমের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানান, এর আগে ১৯৯৬ সালেও ওই ফাউন্ডেশনের নামে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ছিলেন আলম। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৯৯৬ সালে নেওয়া শতকোটি টাকার ঋণ মওকুফ আবেদন করেন তিনি। 

হিন্দুদের বাড়ি ও সম্পত্তি দখলের চেষ্টা 
২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর সড়ক সংস্কার ও প্রশস্তকরণের কারণ দেখিয়ে ভেঙে ফেলেন বিপ্লবী কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতার সমাধির সীমানা দেয়াল ও স্মৃতিস্তম্ভের একাংশ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরে তিনি সমাধিটি সংস্কার করেন। ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতার পারিবারিক সম্পত্তি দখল করেন শাহে আলম। একই বছরের ২৪ জানুয়ারি উপজেলার পশ্চিম তেতলা গ্রামে ১২ পরিবারের কয়েক একর জমি দখলের চেষ্টা করেন আলম। জমির দলিল লিখে নেওয়ার জন্য কৃষক রতন ঘরামীকে ঘরে আটকে রেখে রাতভর নির্যাতন করে শাহে আলমের বাহিনী। পরের দিন ভোরে ৯৯৯ খবর পেয়ে রতন ঘরামীকে উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ জানুয়ারি দুপুরে লোমহর্ষক সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রতন ঘরামী। ওই ঘটনায় আদালতে রতনের করা মামলার এখনো তদন্ত করছে পিআইবি। এদিকে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল ও নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে একুশের গানের রচয়িতা প্রয়াত ভাষাসৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেন। 

ঠিকাদারি কাজ ভাই-ভাগনে, কমিশন ৫-১৮ পার্সেন্ট
২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরিশাল-২ আসনের বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলায় ব্রিজ-কালভার্ট, আয়রন সেতু, সড়ক নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ এবং সংস্কারসহ অবকাঠামো উন্নয়নে কমপক্ষে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এর অধিকাংশ প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন তার ভাই, ভাগনে ও চাচাতো ভাইয়েরা। 

প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, বানারীপাড়া ঠিকাদারি কাজ করতে হলে ৫-১৮ পার্সেন্ট টাকা শাহে আলমকে দিতে হতো। সে তার ভাই-ভাগনে কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন। কমিশনের ওই টাকা তিনি সংগ্রহ করতেন প্রকৌশলীদের মাধ্যমে। 

রাসেল আহমেদ নামে এক ঠিকাদার বলেন, ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ইজিপি) কোনো ঠিকাদার কাজ পেলেও তিনি তা করতে পারতেন না। ওই কাজ নিজের পছন্দের লোকদের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করাতেন শাহে আলম। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য কোনো ঠিকাদার কাজ পেলেও সেখানে অংশীদার হিসেবে ভাই-ভাগনেকে রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তার পক্ষে ঠিকাদারি বাণিজ্যের পুরোটা তদারকি করতেন চাচাতো ভাই নুরুল হুদা তালুকদার ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সুব্রত কুণ্ডু, আওয়ামী লীগ নেতা সামশুল আলম মল্লিক, ভাই রিয়াজ তালুকদার, ভাগনে রুথেন মোল্লা, চাচাতো ভাই মামুনুর রসিদ স্বপন। 

চাঁদাবাজি ছিল শাহে আলমের নিয়মিত ঘটনা
বানারীপাড়া ও উজিরপুরের একাধিক ব্যবসায়ী ও ইটভাটার মালিকরা জানান, শাহে আলম এমপি থাকাকালে সলিয়া বাকপুরে আবদুর রব কেন্দ্রীয় ঈদগাহ নির্মাণ ও বানারীপাড়া সরকারি পাইলট বিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নামে সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা চাঁদাবাজি করেছেন শাহে আলম। দুই উপজেলার ১০০টির ওপরে ইটভাটা রয়েছে। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নামে প্রতিটি ইটভাটা থেকে তিনি গড়ে ১ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়েছেন। এ ছাড়া বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে বছরে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন ইটভাটা থেকে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে শাহে আলমের বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। বানারীপাড়া বালিকা বিদ্যালয় ও উজিরপুরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আদালতে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও হয়েছিল।

স্থানীয়দের দমাতে হাতুড়ি বাহিনী
আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় এবং বিরোধীদের দমন করতে গড়ে তুলেছিলেন হাতুড়ি বাহিনী। ‘এমপি’ শাহে আলমের অকর্মের বিরুদ্ধে কেউ যাতে কথা বলতে না পারেন, সে জন্য সে সময় চাচাতো ভাই নুরুল হুদার নেতৃত্বে এই হাতুড়ি বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি।

স্থায়ী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, নুরুল হুদার নেতৃত্বের হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাওলাদ হোসেন সানার লিজ নেওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেটা প্রশাসনের মধ্যে গড়িয়ে দেন সাবেক এমপি শাহে আলম। রাজাকারের লিস্টে তার বাবার নাম থাকা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় চাখার ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পিকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে একটি পা ভেঙে দেয় শাহে আলমের বাহিনী। এই বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য জাকির হোসেন, বাইশারী ‍ইউনিয়নের সাবেক সদস্য সোহেল। 

সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পি বলেন, ‘শাহে আলম গেজেটভুক্ত রাজাকারের সন্তান উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিলে ২০১৯ সালের ঈদের আগের দিন নুরুল হুদার নেতৃত্বে হাতুড়িপেটা করে আমার ডান পা অচল করে দেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা করলে শাহে আলম বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তা তুলে নিতে বাধ্য করেন।’ 

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের নোটিশ
শাহে আলমের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভার হয়। সভায় শাহে আলমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ এনে ২০২৩ সালে ৩ অক্টোবর সভাপতি মো. গোলাম ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাওলাদ হোসেন সানা স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। ওই নোটিশে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণের ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ, উন্নয়নকাজে ৫ ভাগ হারে কমিশন আদায়সহ ১৭টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল সালম বলেন, এ বিষয়গুলো ‍আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। 

হতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকায় এসেছিল শাহে আলমের বাবা ডা. সায়েদ উদ্দিন তালুকদারের নাম। এমপির প্রভাব খাটিয়ে বাবার নাম বাতিলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। তাই শাহে আলম নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনী লাল দাসগুপ্তসহ ২০ মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরিত এক চিঠি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্তি হয়নি। 

গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর শাহে আলম তালুকদারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় জনতার হাতে মারধরের শিকার হয়ে গুলশান থানা-পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। পরে তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর গুলশান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এক রাতের লুটপাটে কোটি ঘনফুট পাথর লুট

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২০ পিএম
এক রাতের লুটপাটে কোটি ঘনফুট পাথর লুট
জাফলংয়ের ইসিএ এর সংরক্ষিত এই এলাকা থেকে লুট হয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ পাথর। ছবি: খবরের কাগজ

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় পাদদেশে বাংলাদেশের ডাউকি-পিয়ান নদের মিলনস্থল। জল-পাথর আর সবুজ পাহাড়ঘেঁষা এ জায়গাটি হচ্ছে জাফলং। বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতির পাশাপাশি বালু-পাথর সম্পদেরও আধার এটি। বালু-পাথর আহরণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হওয়ায় প্রকৃতির সুরক্ষায় ডাউকি-জাফলংকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার পর ডাউকি-পিয়ান নদীর মোহনায় জমেছিল কয়েক স্তরে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর। বছর বছর পরিমাপ করে রাখা এসব পাথর এখন লুটের মুখে পড়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এক রাতের লুটপাটে এক কোটি ঘটফুট পাথর চুরি হয়ে গেছে বলে সরকারি হিসেবে উঠে এসেছে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী লুট করা পাথরের মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। 

তবে সেই রাতের এই পাথর চুরির ঘটনাকে স্থানীয়রা ক্রোধের স্বরে বলছেন, ‘লুটতরাজ’। এ বিষয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘সেদিন বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। হাজার হাজার মানুষ এসে উপোসিদের মতো হামলে পড়েছিল এই পাথর লুট করে নিতে।’

গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার গেজেট প্রকাশ হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এই আবেদন করেছিল ২০১২ সালে। এরপর থেকে কয়েকটি ধাপে জাফলং থেকে বালু ও পাথর কোয়ারির ইজারা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে বছর বছর পাথর সম্পদ মজুতের বিষয়টি পরিমাপের মধ্যে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সংরক্ষিত এলাকায় পাথরের পর্যবেক্ষণ চলে। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ৫ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে সেখানে ব্যাপক লুটপাটে প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর উধাও হয়ে গেছে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সেখানে সেনা সদস্যরাও যেতে পারেননি। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সরকার পতনের পর দফায় দফায় বিজয় মিছিল করে ছাত্র-জনতা। এর মধ্যে জাফলং ও তামাবিল এলাকায় ইউপি শাখা বিএনপির আয়োজনে সর্বশেষ মিছিল হয় বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আর এই মিছিলের পরই রাতে চলে পাথর লুট। এক রাতে শতকোটি টাকার পাথর লুটের বিষয়টি সরকারি সম্পত্তি লুটের সঙ্গে তুলনা করেছে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘খুব সুচতুরভাবে লুট হয়েছে। লুটের আগে সেখানকার কয়েকটি সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন আকারে অবহিত করা হয়েছে। তাদের পরবর্তী নির্দেশনা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

তামাবিলের পর জাফলং
জাফলংয়ের এক পাশে রয়েছে তামাবিল স্থলবন্দর। গত ৫ আগস্ট রাতে তামাবিলের সরকারি কয়েকটি দপ্তরে ভাঙচুর ও লুটপাট চলে। এরপরই জাফলংয়ে লুটতরাজের ঘটনা ঘটে। সিলেট কাস্টমস বিভাগের যুগ্ম কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম জানান, ৫ আগস্ট বিকেল থেকে একটি ভয়াবহ সময় পার করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা। রাত ৮টার দিকে হাজারখানেক লোকজন হামলা চালায় কাস্টমস গুদামে। সেখানে বিভিন্ন সময় আটক করা প্রায় সোয়া ৬ কোটি টাকার মালামাল ট্রাক দিয়ে লুট করে নিয়ে যায় তারা। কর্মকর্তাদের থাকার কক্ষগুলোও লুট হয়। এলসির পাথর আমদানি রুখতেই আগে তামাবিলে হামলা হয়, এরপর জাফলং-এ গিয়ে লুটতরাজ চালায় তারা। 

গত বছরের ২৮ নভেম্বর ভারতের ডাউকি থেকে জাফলংয়ে ইসিএর মজুত করা পাথরের স্পটে দেখা গেছে, ডাউকি-পিয়াইন মোহনা পুরোটা পাথরের স্তূপে ঢাকা পড়েছে। লুটতরাজের প্রায় দেড় মাস পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর ড্রোন দিয়ে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, পাথরের আস্তরণের দুই দিক প্রায় ফাঁকা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্যরেখা পেরিয়ে ডাউকি-পিয়ান নদীর দুই দিক বর্তমানে পাথরশূন্য। স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, সেই রাতের লুটতরাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স ও তার কর্মীরা। এর মধ্যে শিমু, ইসমাঈল, মামুন নামের ব্যক্তিরা লুটপাটে লোক জড়ো করেন। হান্নান নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে লুটের পাথর বিক্রি করে প্রকাশ্যে টাকা ভাগ করারও অভিযোগ রয়েছে। লুটতরাজের বড় অভিযোগ সিলেট থেকে জেলা বিএনপির সহ-সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহ পরাণের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তার অনুসারী আব্দুর রাজ্জাক ও জাহিদ খানকেও লুটপাটে লোক জড়ো করতে দেখা গেছে। তবে ঘটনাস্থলে ছিলেন না বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ পরাণ।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও বিএনপি নেতা আমজাদ-শাহ পরাণের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদিসহ অভিযোগ থাকলে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেব। কিন্তু তথ্যপ্রমাণসহ কেউ কোনো অভিযোগ দিতে পারছে না।’

‘ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের’ খনি পাথর লুট 
২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি জাফলংকে ‘ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে জাফলংয়ের ২২ দশমিক ৫৯ একর জায়গাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। উন্মুক্ত শিলাস্তর, চুনাপাথর সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য জাতীয় স্বার্থে ২৫ দশমিক ৫৯ একর ভূমিকে ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে বলা হয়েছিল, ওই ভূমিতে আন্তর্জাতিক মানের একটি ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকা ছাড়াও ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় একটি ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। 

বর্তমান চিত্র ও বেলার পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের রায়ে জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার নির্দেশনা অনুযায়ী বালু ও পাথর উত্তোলন কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইসিএ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে বলা হয়েছিল। এ নির্দেশনার আলোকে জাফলংয়ে প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও গোপনে বিভিন্ন পন্থায় উত্তোলন চালু রাখে সংক্ষবদ্ধ পাথরখেকোরা। তবে প্রশাসনের অভিযানে একসময় পাথর উত্তোলন প্রায় বন্ধ হয়, প্রাণ ফিরে পায় জাফলং। কিন্তু সরকার পতন ঘটলে এক রাতের লুটতরাজের পর অরক্ষিত হয়ে পড়েছে পুরো জাফলং। যত্রতত্রভাবে বালু-পাথর তোলার হিড়িক দেখা গেছে। যেসব জায়গা থেকে পাথর ও বালু তোলা হচ্ছে, সেখানে কাউকে ছবি পর্যন্ত তুলতে দেওয়া হয় না। সংঘবদ্ধ চক্রের প্রভাবে ইসিএর নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। 

সম্প্রতি জাফলং পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেটের একটি টিম। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইসিএ’র গেজেট প্রকাশের পর পাথর উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় জাফলংয়ের প্রকৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পূর্বের অরাজক অবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছে পরিস্থিতি। এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। জাফলংয়ে বালু-পাথর ঘিরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সব সময় ছিল। এই সিন্ডিকেট তাড়ানো প্রশাসনের জন্য কোনো কষ্টকর বিষয় বলে আমি মনে করি না। কারণ সরকারের প্রতিনিধিত্ব যারা করছেন, তারা যোগ্য এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।’ 

মনিটরিংয়ে নাইটভিশন
সরকার পতনের দিন লুটতরাজের পর অরক্ষিত জাফলং পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। জাফলং ডাউকি-পিয়াইন নদীর পাশ দিয়ে বালু-পাথর পরিবহন কাজে নিয়োজিত যানবাহন (পে-লোডার ও ড্রাম ট্রাক) যাতায়াত রোধে বল্লাঘাট মসজিদের নিচে রাস্তার দুই দিকে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী মজবুত ব্যারিকেড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিজিবি ও পুলিশের সহায়তায় জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম সার্বিক নজরদারির ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের এসব পদক্ষেপের বিষয় জানিয়ে ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম জানান, অনেক সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, সেসব সিস্টেম পুনরায় সচল করে অচিরেই জাফলংয়ের পুরো ইসিএভুক্ত এলাকা সিসিটিভি মনিটরিং সিস্টেমে নাইটভিশনের আওতায় আনা হবে।

সংস্কারে খরচ ১৮ কোটি টাকা

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩০ পিএম
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
সংস্কারে খরচ ১৮ কোটি টাকা
শেরপুর জেল। ছবি: খবরের কাগজ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি কারাগার সংস্কার করতে সরকারের প্রায় ১৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ এক সূত্র খবরের কাগজকে এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্রমতে, ক্ষতিগ্রস্ত কারাগারগুলোর সংস্কারকাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। 

এদিকে কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, এখনো প্রায় ৫০০ বন্দি পলাতক রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া নথি সংগ্রহ ও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলমান রয়েছে। আসামিদের ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে সূত্র বলছে, ওই তথ্যের ভিত্তিতে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া আদালত থেকেও পুড়ে যাওয়া নথি সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।

কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বিভিন্ন কারাগার থেকে লুট হওয়া ৯৪টি অস্ত্রের মধ্যে ৬৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো হদিস মেলেনি ২৫টি অস্ত্রের। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৪৫০টি থানা আক্রান্ত হয়েছে। কারাগারগুলোও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ওই সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ (কেরানীগঞ্জ) দেশের মোট ১৭ কারাগারে হামলা, অগ্নিকাণ্ড, অস্ত্র লুট ও বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। দায়িত্ব গ্রহণের পর কারাগারগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। 

হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ কারাগার হলো কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ), গাজীপুরের কাশিমপুর-২ ও হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, নরসিংদী, মাদারীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, চাঁদপুর ও জামালপুর, গাজীপুর, জেলা কারাগার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার। নরসিংদী কারাগার সংস্কারে ১১ কোটি ২১ লাখ ও শেরপুরে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। 

গত ২ অক্টোবর জামালপুর জেলা কারাগার পরিদর্শনের সময় কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন সাংবাদিকদের জানান, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের অনেকেই তাদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছেন। একটি বড় অংশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনো ৫০০-এর মতো বন্দি পলাতক রয়েছেন।

তিনি বলেন, কারাগার থেকে লুট হওয়া অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কারাগারে অন্য সময়ের তুলনায় এই মুহূর্তে বন্দিদের সংখ্যা কম। তবে সম্প্রসারণ কার্যক্রম শেষ হলে কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়বে।

কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘আমাদের কোনো ঠিকাদার যদি কাজ করতে অপারগ হন তাহলে নিয়ম মেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বা চুক্তি বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করা হবে। বন্দিদের খাবারে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, অনুমোদন পেলে বাস্তবায়ন করা হবে।’

ক্ষতিগ্রস্ত কারাগারগুলো সংস্কার ও লুট হওয়ার অস্ত্রের বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান গত বৃহস্পতিবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারাগারগুলোর সংস্কারের কাজ স্বল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। লুট হওয়া ৯৪টি অস্ত্রের মধ্যে ৬৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধার ও পলাতক আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া পুড়ে যাওয়া নথি সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারাগারে অগ্নিসংযোগ ও সেলের তালা ভেঙে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যান। পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুর করেন হামলাকারীরা। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নরসিংদী জেলা কারাগার। 

সরকার পতনের দিন (৫ আগস্ট) শেরপুর জেলা কারাগারে বিক্ষুব্ধ লোকজন ভাঙচুর করে আগুন দেয়। কারাগারে থাকা ৫১৮ বন্দির সবাই পালিয়ে যান। এ সময় এই কারাগারেও অস্ত্র ও মূল্যবান সামগ্রী লুটের ঘটনা ঘটে। সরকার পতনের দিন থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ায় দফায় দফায় হামলা চলে আরও ১৫ কারাগারে।

নরসিংদী কারাগারে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
অগ্নিকাণ্ডে বন্দিদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, কনডেমড সেল ও অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সবখানে ছিল পোড়া চিহ্ন, লণ্ডভণ্ড অবস্থা। অগ্নিকাণ্ডের পর দেখে মনে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো ধ্বংসস্তূপ। এ ছাড়া পুড়ে যায় কারাগারের সব নথি। 

গতকাল শুক্রবার নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে গত ১৯ জুলাই লুট হওয়া রাইফেল উদ্ধারের পর থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে সেনাবাহিনী। সকালে শহরের মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের সেনা ক্যাম্পে অস্ত্রটি হস্তান্তর করা হয়।

এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার পাইকগাছার নির্মাণাধীন একটি বাড়ির মাটির নিচে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় রাইফেলটি উদ্ধার করে সেনাবাহিনী।

লাগামহীন ডিমের বাজার

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৫ পিএম
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
লাগামহীন ডিমের বাজার
সরকার প্রতি পিস ডিমের দাম ১১ টাকা ০১ পয়সা বেঁধে দিলেও পোল্ট্রি ফার্মগুলো প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে ১২ টাকার ওপরে। ফলে চট্টগ্রামে ডিমের দাম কমছে না কোনোভাবেই। ছবি: খবরের কাগজ

বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ডিমের বাজার। পাইকারিতে গত ৮ দিনে চারবার বেড়েছে পণ্যটির দাম। অপরদিকে খুচরা বাজারেও একেক জায়গায় একেক দরে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দর লাগামহীনভাবে বাড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা।

ডিমের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পেছনে পাইকারি ব্যবসায়ীরা পোলট্রি ফার্ম মধ্যস্বত্বভোগী ও আড়তদারদের দোষারোপ করছেন। তারা বলছেন, সরকার প্রতি পিস ডিম পাইকারিতে ১১ টাকা ০১ পয়সায় বিক্রি নির্দেশনা দিয়েছে। অথচ পোল্ট্রি ফার্মগুলো সরকার নির্ধারিত দর না মেনে ১২ টাকার ওপরে প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে। তারা প্রতিটি ডিমে দেড় থেকে দুই টাকা লাভ করছে। অপরদিকে প্রান্তিক খামারিরা সরাসরি পাইকারের কাছে ডিম বিক্রি করতে পারে না। মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে পাইকারের কাছে আসে। আড়তদাররাও বাড়তি দরে বিক্রি করছে পণ্যটি। এসব কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। 

এদিকে দাম বাড়ায় পাইকারি বাজার পাহাড়তলীতে ডিমের সরবরাহ কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিটি গাড়িতে ১ লাখ ৪৪ হাজার পিস ডিম থাকে। বর্তমানে প্রতিটি ডিম কিনে আনতে খরচ পড়ছে ১২ টাকা ৫০ পয়সা। ওই হিসেবে এক গাড়ি ডিম আনতে একজন পাইকারকে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে ১৮ লাখ টাকা। আগে ১০ থেকে ১১ লাখ টাকা খরচ পড়ত। বাড়তি ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ বাড়ায় ডিম আনতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পাইকাররা। 

পাহাড়তলী পাইকারি বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, গত ৮ দিন ধরে পাইকারিতেই প্রতিটি ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সার ওপরে বিক্রি হয়েছে। সেখানে প্রতিটি ডিম গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১২ টাকা ৫০ পয়সায়, ২৮ সেপ্টেম্বর ১২ টাকা ৪০ পয়সায়, ২৯ সেপ্টেম্বর ১২ টাকা ৫০ পয়সায়, ৩০ সেপ্টেম্বর ১২ টাকা ৭০ পয়সায়, ১ অক্টোবর ১২ টাকা ৭০ পয়সায়, ২ অক্টোবর ১২ টাকা ৬০ পয়সায়, ৩ অক্টোবর ১২ টাকা ৮০ পয়সায় এবং ৪ অক্টোবর ১২ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। 

চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল শুক্কুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদেরকে প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সার ওপরে কিনে আনতে হচ্ছে। ডিম আনতে গিয়ে আমাদের ব্যয়ের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তাই অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী ডিম আনছেন না। এতে করে সরবরাহও কিছুটা কমেছে।’

এদিকে খুচরা পর্যায়েও একেক জায়গায় একেক দরে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। খুচরা বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরের নাসিরাবাদ এলাকায় প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা ৫০ পয়সায়। আবার নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকায় ১৪ টাকার ওপরে প্রতিটি ডিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। 

নগরের নাসিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক সুবীর কান্তি নাথ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিমের বাজার অস্বাভাবিক বেশি। আমি ৩০টি ডিম ৪০০ টাকায় কিনেছি। আবার মাছের বাজার গরম। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১৯০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা তো সরকার নির্ধারিত দরের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। আমরা সাধারণ ক্রেতারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। কারণ আমাদের আয় তো নির্দিষ্ট। সরকারের উচিত ভোগ্যপণ্যের দিকে নজর দেওয়া, যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পায়।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। সেটা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। অপরাধীরা শাস্তির আওতায় আসছে না। তাই তারা অপরাধ করেই চলেছে। কাজেই কারা সিন্ডিকেট বা কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করা সম্ভব হবে।’ 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা পাহাড়তলী বাজারে অভিযান পরিচালনাকালে ডিমের দামে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছি। প্রদর্শিত মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দামে ডিম বিক্রি করায় কয়েকজনকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়েছে। আমরা অভিযানে গেলেই ব্যবসায়ীদের নিয়ম মেনে ব্যবসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

সংস্কার ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে ১৮ দলের সংলাপ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫১ পিএম
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫৯ পিএম
সংস্কার ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে ১৮ দলের সংলাপ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তৃতীয় দফায় আজ সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারের সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার কাছে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব তুলে ধরবে দলগুলো। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কারকাজের অগ্রগতি এবং কবে নাগাদ শেষ হতে পারে এই কার্যক্রম, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে তার পরিষ্কার ধারণা পেতে চাইবে ১৮টি রাজিনৈতিক দল। 

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আজ বেলা আড়াইটায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠক দিয়েই শুরু হবে এবারের সংলাপ। বিএনপির সংলাপের নেতৃত্ব দেবেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, আমরা বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদ (ফারুক) বৈঠক করবে। তবে আমন্ত্রণ পেলেও সংলাপের তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর। 

ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর এর আগে দুই দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ছয়টি কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে এই সংলাপের আয়োজন করা হচ্ছে। তবে কমিশনগুলোতে কারা সদস্য হবেন, তা সংলাপে নয়- সরকারই ঠিক করবে। মূলত, রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে বিভিন্ন প্রস্তাব বা পরামর্শ চাওয়া হবে সরকারের পক্ষে। পাশাপাশি নির্বাচনি রোডম্যাপ, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার ইস্যুতে সুনির্দিষ্টভাবে কথা বলবেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

দুই ইস্যুতে প্রাধান্য দেবে বিএনপি
দলীয় সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এবারের সংলাপে বিএনপি দুটি বিষয় সামনে রেখে আলোচনা করবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কারকাজ শেষ করার রোডম্যাপকে প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হবে। এর বাইরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার এবং ছাত্র-জনতার গণহত্যার বিচার কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার কথা বলা হবে। সরকারের বক্তব্য ছাড়াও বিএনপি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সিনিয়র নেতাদের এই প্রতিনিধিদলে বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনি রোডম্যাপ ও রাষ্ট্র সংস্কার রোডম্যাপ ইস্যুতে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কিছু বক্তব্য আছে সেগুলো বলব এবং প্রস্তাবনা তুলে ধরব। বিশেষ করে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগ নিয়ে আমরা কথা বলব। তা ছাড়া সরকার যা জানতে চাইবে, সে বিষয়েও কথা বলব।’ 

জামায়াতে ইসলামী 
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে বেলা ৩টায়। এতে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে নায়েবে আমিরসহ সিনিয়র নেতারা অংশ নেবেন। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রেখে রাষ্ট্র সংস্কারে লিখিত একটি প্রস্তাবনা তাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে চূড়ান্ত করেছে জামায়াত। তাদের প্রস্তাবনায় থাকছে, একক কর্তৃত্বপরায়ণ কোনো সরকার যাতে আগামীতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া; ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নির্বাচনি কাঠামো গঠন; রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, বিভেদ ও বিভাজন কমিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা। সংলাপ শেষে তাদের প্রস্তাবনা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হবে। 

জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ জানান, রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত ছয়টি কমিশনের কাছে পৃথকভাবে তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন। তবে এবারের সংলাপে মূলত নেতারা প্রধান উপদেষ্টা যেসব বিষয়ে মত চাইবেন, তারা সেসব বিষয়ে মতামত দেবেন।

হেফাজতে ইসলাম
আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। এবারের আলোচনায় চার ইস্যুর ওপর গুরুত্ব দেবে হেফাজত। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণ-হত্যাকাণ্ডের বিচার; হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার; বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল এবং নতুন শিক্ষানীতি ব্যবস্থায় কমিটিতে দুজন বিশেষজ্ঞ আলেম-ওলামায়ে অন্তর্ভুক্ত করা। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ 
ইসলামী আন্দোলন আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীরের নেতৃতে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল শনিবার বিকেল ৫টায় যমুনায় যাবে। এই দলে থাকবেন নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।

দলটির যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংলাপে আমরা ছয়টি কমিশনের কাজের অগ্রগতি, কমিশন কীভাবে কাজ করবে, কত দিনের মধ্যে কাজ শেষ করবে, এসব বিষয়ে আলোচনা করব। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবনা না দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে লিখিত প্রস্তাবনা জমা দেব।’ 

৬-দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ
আজ বেলা সাড়ে ৩টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে যাবে ৬-দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। সংলাপে অংশ নেবেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুমসহ ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেবে।

এ বিষয়ে সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা কখন শেষ হবে, সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা বোঝার চেষ্টা করব। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে কিছু প্রস্তাবনা মঞ্চের পক্ষে তুলে ধরব।’

বাম গণতান্ত্রিক জোট 
আজ বিকেল ৪টার দিকে যমুনায় যাচ্ছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। তাদের মধ্যে এ সভায় থাকবেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা আবদুল আলী, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু। 

বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে বাম জোটের সিনিয়র নেতা ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলো কীভাবে কাজ করবে এ নিয়েই মূলত আলোচনা হবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে। সংস্কার কমিশন নিয়ে ইতোমধ্যে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই নিয়ে সভায় আপত্তি জানাব।’

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদ (ফারুক)
আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় এবি পার্টি এবং অপরদিকে সন্ধ্যা ৬টায় যমুনায় যাবেন গণ অধিকার পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা রেজা কিবরিয়া, আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান, সদস্যসচিব ফারুক হাসান। প্রধান সদস্য ৫০ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদের গঠনের কথা তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছেন ফারুক হাসান।

এবি পার্টির প্রতিনিধিদলে থাকছেন আহ্বায়ক এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী, সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাস্ট্র সংস্কার এজেন্ডা মোটা দাগে তিনটি। আমরা রাজনৈতিক দল ও সরকার কাঠামোতে সংস্কার চাই; আইন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার এবং জনপ্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থাপনার সংস্কার। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব হলো, দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পদে পর পর অথবা বিরতি দিয়ে দুই মেয়াদের বেশি কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন না। দলের প্রধান ও দায়িত্বশীল পদগুলোতেও একজন ব্যক্তি দুই বা তিন মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এতে দলে গণতন্ত্রের চর্চা, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি ও জবাবদিহির পথ সুগম হবে।’

এদিকে শনিবারের সংলাপ আমন্ত্রণ পেলেও তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে এতে অংশ নিচ্ছে না গণ অধিকার পরিষদ। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সংলাপে অংশ নেবেন জানিয়ে দলটির সভাপতি নূরুল হক নুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘এক সঙ্গে তিন-চারটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমরা দলের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে পরে তারিখ নির্ধারণের কথা বলেছি।’