
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চট্টগ্রামের ৬০৬টি গার্মেন্ট কারখানা ১২ দিন বন্ধ ছিল। এতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, বর্তমানে ব্যাংক থেকে টাকাও তোলা যাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, দেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশে কারফিউ চলাকালে গার্মেন্ট কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকার পতন ও বন্যার কারণে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে মোট ১২ দিন কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) তালিকাভুক্ত চট্টগ্রামের ৬০৬টি কারখানায় দৈনিক গড়ে ৪০০ কোটি টাকা করে ক্ষতি হয়েছে। ওই ক্ষতির মোট পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
এদিকে সরকার পতনের ফলে দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে চাকরি পাওয়ার জন্য গত ১০ আগস্ট চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় ‘প্যাসিফিক ক্যাজুয়েল গার্মেন্টস’ নামের গার্মেন্টসে ভাঙচুর ও আন্দোলন করেছেন শ্রমিকরা। একই সময়ে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘ইউনিভো’ গার্মেন্টসে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল চাকরি পাওয়া। গার্মেন্ট দুটির সামনের আন্দোলন হওয়ায় তেতরে কাজে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্যাসিফিক ক্যাজুয়েল গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘পোশাক কারখানায় ৮০ শতাংশ মহিলা শ্রমিক কাজ করেন। কিছু পুরুষ শ্রমিক সেদিন কারখানার সামনে এসে আন্দোলন করতে থাকেন। এতে আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দাবি ছিল নতুন নিয়োগ। ওই আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমাদের কারখানার কর্মী ছিলেন না। বহিরাগতরা এসে আন্দোলন করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।’
অন্যদিকে গত ২২ আগস্ট ‘চিটাগং ফ্যাশন স্পেশালিস্ট টেক্সটাইল লিমিটেড’ নামে অন্য একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও অর্জিত ছুটির দাবিতে নগরীর ইপিজেডের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
এতে প্রায় ৬ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। পরে শিল্প-পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-কালুঘাট সেতু সড়কের সিঅ্যান্ডবি এলাকায় ওয়েল গ্রুপের মালিকানাধীন ওয়েল ফ্যাশনের শ্রমিকরা প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক নিয়ে বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামেন। খবর পেয়ে শিল্প-পুলিশ গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
পরে সেনাবাহিনী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ওয়েল গ্রুপের মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে আগামী ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জুলাই মাসের বকেয়া বেতন এবং ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক পণ্য শিপমেন্ট করা সম্ভব হয়নি। বায়ারদের কাছে টাকা আটকে গেছে। বর্তমানে ব্যাংক থেকে টাকা তোলাও যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সব পোশাক কারখানাতেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমাদের কারখানার সমস্যা এই মাসেই সমাধান হয়ে যাবে। শ্রমিকরা আমাদের প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্নভাবে পোশাক কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সময়মতো বন্দর থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ছাড় নেওয়া যায়নি। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশে সময়মতো পণ্য পাঠানো যায়নি। কারখানা থেকে তৈরি পণ্য জাহাজে তোলা সম্ভব হয়নি। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বিজিএমইএ সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, দেশের অর্থনীতিকে সুষম রাখতে হলে পোশাক খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বর্তমানে অনেক ব্যাংকে লেনদেন করা যাচ্ছে না। এতে পোশাক কারখানার মালিকদের ভোগান্তি হচ্ছে। এর প্রভাব আমদানি-রপ্তানি খাতে পড়ছে। ব্যাংক থেকে টাকা না পাওয়ায় শ্রমিকদের ঠিক সময়ে বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। এতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকরা কাজ করতে না পারা, পোশাক কারখানা বন্ধ থাকা ও পণ্য বিদেশে পাঠাতে না পারার কারণে পোশাক মালিকদের বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিল্প-পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশের পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামের ১৫ থেকে ২০টি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। তবে শিল্প-পুলিশের সহায়তায় মালিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। শ্রমিকরা চাকরি পাওয়ার জন্য এবং কেউ বেতন-বোনাসের জন্য আন্দোলন করেছে। তবে বিষয়গুলো সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে।’