আলাদিনের চেরাগ হাতে না পেলেও মাত্র ১০ বছরে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আস্থাভাজন জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক তদবিরের পাশাপাশি সড়ক ও সেতু বিভাগে সিন্ডিকেট তৈরি করে পারসেন্টেজ নিতেন ওয়ালিদ। তিনি বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণেও ছিলেন যুক্ত। এসব করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন ওয়ালিদ, তার মূল দায়িত্ব তথ্যসেবা দেওয়ার কথা হলেও তিনি এই ক্ষেত্রে সময়ও দিতে পারতেন না। দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরা ফোন করে ওয়ালিদকে কখনোই পেতেন না- এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ জন্য সংশ্লিষ্টরা ওয়ালিদকে ‘ভিআইপি পিআরও’ বলেও সম্বোধন করতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তথ্য ক্যাডারের ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। শেখ পরিবারের এক নেতার বিশেষ তদবিরে সুযোগ পান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) হিসেবে চাকরি করার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় ওবায়দুল কাদেরের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন শেখ ওয়ালিদ। পিআরও হলেও মূলত ছিলেন ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট ও আস্থাভাজন। মন্ত্রণালয়ে তৈরি করেন ‘পারসেন্টেজ সিন্ডিকেট’। শুধু তা-ই নয়, সরকারের কর্মচারী হয়েও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (শীর্ষ পদ) ওবায়দুল কাদেরের পদের প্রভাবও বিস্তার করতে শুরু করেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। নিজের ঘনিষ্ঠ লোকদের জন্য ওবায়দুল কাদেরকে দিয়ে করাতেন তদবির। এই তদবিরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কাজই নয়, রাজনৈতিক পদবি, দলীয় নমিনেশন (চেয়ারম্যান), বদলি বাণিজ্যও করাতেন শেখ ওয়ালিদ। হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৩ সালে সেতু বিভাগের পিআরও হিসেবে যোগ দেন শেখ ওয়ালিদ। সড়ক বিভাগের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র চলে যান। ফলে সড়ক ও সেতু দুই বিভাগেরই তথ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব পান ওয়ালিদ। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এপিএস মহিদুল হক আপেল, রাজনৈতিক সচিব আব্দুল মতিন, পিও জাহাঙ্গীর আলম ও শুখেন চাকমাকে নিয়ে ওয়ালিদ মন্ত্রণালয়ে গড়ে তোলেন পাঁচ সদস্যের সিন্ডিকেট। সড়ক বিভাগের সাবেক পিআরও নাসিরকে আর মন্ত্রীর কছে ভিড়তে দেয়নি এই সিন্ডিকেট। শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ‘সব ঠিক চলছে’ বলে মন্ত্রণালয়েও আসতে নিরুৎসাহিত করত। এই সিন্ডিকেট জোট হয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাব-কন্ট্রাক্টরি, বিভিন্ন তদবির করত এবং এসব কাজের পারসেন্টেজ সবাই মিলে ভাগ করে নিতেন। এর মধ্য থেকে একটি পারসেন্টেজ মন্ত্রীর পকেটে যেতো।
এদের দাপটের সময়ে দেশের মেগা প্রকল্পগুলো থেকে মেগা দুর্নীতি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল ও চার লেন সড়কের কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা হাতে রেখে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের উপকরণ মাটি, বালু, ইট-পাথর, রড সরবরাহের ঠিকাদারদের কাছ থেকেও নিতেন পারসেন্টেজ। পাশাপাশি সড়ক ও সেতু বিভাগ, অধিদপ্তরগুলোতে টাকার বিনিময়ে কর্মকর্তাদের পদায়ন করতেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা। একই সঙ্গে কাজের বিল নিয়ে নয়ছয়, বিল পাস করিয়ে দেওয়া, পদোন্নতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ হেন কোনো কাজ নেই যা তারা করেননি। কেউ এই অর্থ পরিশোধ করতে বিলম্ব করলে কাজ অন্য ঠিকাদারদের হাতে চলে যেত।
আওয়ামী লীগের আমলে সড়ক ও সেতু বিভাগে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আর এই সুযোগে নামে-বেনামে নানা খাত সৃষ্টি করে কয়েক শ কোটি টাকা কামিয়েছেন ওয়ালিদ ও তার সিন্ডিকেট। দুই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে কোথাও যথাযথভাবে সময় দিতে পারেননি ওবায়দুল কাদের। এই সুযোগটাই কাজে লাগান ওই সিন্ডিকেট সদস্যরা। ওয়ালিদ শুরু থেকেই মন্ত্রণালয়ের তদবির করতেন তা নয়, আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবির তদবিরও করাতেন তিনি। ওবায়দুল কাদেরের আস্থাভাজন হওয়ায় অর্থের পেছনে নয়, অবৈধ অর্থই ছুটেছে শেখ ওয়ালিদ ফয়েজের পেছনে।
এই টাকা দিয়ে শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ সাধারণ জীবনযাপনের বদলে রাজকীয় জীবনযাপন শুরু করেন। অবৈধ অর্থ দিয়ে শুরু করেছিলেন হাউজিং ব্যবসা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় জমি কিনে মাটি ভরাটের পর প্লট ও ফ্ল্যাট কিনেছেন সরকারের এই কর্মচারী। ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করেও অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তার বাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট থাকার খবর পাওয়া গেছে। কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরে কিনেছেন জমি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকটি স্থানে ওবায়দুল কাদেরের তদবিরে হাঁকিয়েছেন দোকান। এসব সম্পদ নিজের নামে না করলেও ভাইবোন ও ঘনিষ্ঠদের নামে করেছেন শেখ ওয়ালিদ।
বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, জেলার চিতলমারী উপজেলার বড়গুনী গ্রামের শেখ ফয়জুল্লাহর ছেলে শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। ওবায়দুল কাদেরের আস্থাভাজন এই পিআরও নিজ উপজেলায়ও প্রভাব খাটাতেন। ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদে তিনি নিজের উপজেলা-ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের জন্য নানা সুপারিশ করতেন। পাশাপাশি বোনকেও চেয়ারম্যান বানিয়েছেন তিনি। তার মেজো বোন মিলিয়া আমিনুল গোপালগঞ্জ জেলার ২ নম্বর বর্নি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এলাকায় আত্মীয়স্বজন সবার জন্য তদবির করাতেন ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে।
আধিপত্য কাজে লাগিয়ে এলাকায় নিজের এবং ভাইবোনের নামে করেছেন অঢেল সম্পত্তি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ ওয়ালিদ অবৈধ অর্থে নানান কিছু গড়ে তোলেন। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে পাঁচ বিঘা পেলেও নিজের তদবির বাণিজ্যের অর্থের মাধ্যমে এখন তিনি ৯ বিঘা সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, অবৈধ অর্থে আরও গড়েছেন দুটি মৎস্যঘের ও একটি কলার বাগান।
ওয়ালিদের বাবার সেমিপাকা বাড়ি ছিল। তবে ওবায়দুল কাদেরের বদৌলতে করেছেন বাগানবাড়ি। পুরো এক বিঘা জায়গার ওপর ইটের উঁচু প্রাচীরঘেরা তার বাড়িটি। ইতোমধ্যে দোতলা একটা বাড়ি তৈরি হয়েছে। পাশে একতলা নির্মাণাধীন বাড়ি করতেও দেখা যায়। এ ছাড়া শেখ ওয়ালিদের শ্বশুরের দোতলা নির্মাণাধীন আলিশান বাড়ি রয়েছে। সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রভাবে ২০২৩ সালে বেদখলে থাকা ২ একর ২৯ শতক জমি প্রভাব খাটিয়ে দখলে নিয়েছেন। বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগও জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরই আত্মগোপনে যান ওবায়দুল কাদের। এরপর কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়ে চলেন সেই ভিআইপি পিআরও ওয়ালিদ। এখন তিনি তথ্য অধিদপ্তরে কর্মরত।
যদিও নিজের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আমার কোথায় বাড়ি-গাড়ি রয়েছে তা আপনারা খুঁজে দেখতে পারেন। আমি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে আপনাদের (সাংবাদিক) সম্পর্ক ভালো। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন টেন্ডার বা তদবির বাণিজ্য আমার কাজ নয়। রাজনৈতিক তদবির তো আমার কাজও না। বাগেরহাট নিজের এলাকার সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, বাবা-দাদার আমল থেকে আমরা কিছু সম্পত্তি পেয়েছি। সেগুলো দিয়ে কিছু কৃষিকাজ ও মাছের ঘের তৈরি হয়েছে। এর বাইরে এত কিছু নেই।’