ঢাকার অর্থঋণ আদালতে গত জুলাই মাসে দোতরফা ও একতরফা মিলে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০০টি। এর মধ্যে মাত্র ৬৮টি মামলা দোতরফা নিষ্পত্তি হয়েছে, আর বাকি ৬৩২টি মামলাই নিষ্পত্তি হয়েছে একতরফা। শতাংশের হিসাবে দেখলে মামলাগুলোর মধ্যে দোতরফা নিষ্পত্তির হার ১০ শতাংশেরও কম, কিন্তু একতরফা নিষ্পত্তির হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। এর বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ (এডিআর) অন্যান্য পদ্ধতিতেও কিছু মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে ওই মাসে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর কার্যালয়ে আসা ‘ঢাকা জেলা জজশিপের জুলাই ২০২৪ ইং মাসের দেওয়ানি মোকদ্দমার কার্যবিবরণী’তে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে গত এপ্রিলের কার্যবিবরণীও দৈনিক খবরের কাগজের হাতে আসে। পরের মাস মে মাসে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল উদ্দিন এই বিবরণীতে স্বাক্ষর করার পর তা সলিসিটর কার্যালয়ে আসে।
ওই বিবরণী অনুসারে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে গত এপ্রিল মাসে দোতরফা ও একতরফা মিলে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২৩টি। এর মধ্যে মাত্র ৪৬টি মামলা দোতরফা নিষ্পত্তি হয়েছে, কিন্তু একতরফা নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭৭টি। শতাংশের হিসাবে দেখলে এর মধ্যে দোতরফা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, যখন একতরফা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৯১ দশমিক ২০ শতাংশ।
এর বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ (এডিআর) অন্যান্য পদ্ধতিতেও ১৬২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সেটি হিসাবে আনলে ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতে নিষ্পন্ন মোট ৬৮৫টি মামলার মধ্যে দোতরফা ও একতরফা মামলা নিষ্পত্তির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭ ও ৭০ শতাংশ। আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর কার্যালয়ে আসা ‘ঢাকা জেলা জজশিপের এপ্রিল ২০২৪ মাসের দেওয়ানি মোকদ্দমার কার্যবিবরণী’তে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সলিসিটর দপ্তরে আসা এর আগের মাস অর্থাৎ গত মার্চে মামলা নিষ্পত্তির চিত্রও প্রায় একই। ওই মাসে দোতরফা ও একতরফা মামলার সঙ্গে এডিআরসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে নিষ্পন্ন মামলার মোট সংখ্যা ৮০২টি। যেখানে দোতরফা মামলা নিষ্পত্তির হার ৮ শতাংশেরও কম, কিন্তু একতরফা মামলা নিষ্পত্তির হার প্রায় ৭২ শতাংশ।
দোতরফা মামলা নিষ্পত্তির হার এত নগণ্য বা একতরফা মামলা নিষ্পত্তির হার এত বেশি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি জানতে চাইলে সাবেক বিচারক শাহজাহান সাজু দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘নানা কারণেই মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হতে পারে। তবে যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়, তাদের অনেকেই হয়তো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় করতে গিয়ে সফল হননি, দেউলিয়া হয়ে গেছেন। পরে ব্যবসায় গুটিয়ে অফিসে তালা ঝুলছে।
কিন্তু মামলা হওয়ার পর হয়তো ওই ঠিকানাতেই আদালতের সমন বা সব কাগজপত্র যায়। আমার বিশ্বাস এসব কারণে তারা আদালতের সমন বা কাগজপত্র পান না। ফলে মামলাও একতরফা নিষ্পত্তির দিকে এগোয়। কিন্তু একতরফা নিষ্পত্তির পর যখন দেখে যে তার বিরুদ্ধে ক্রোক/ডিক্রি বা এমন রায় হয়ে গেছে, তখন টনক নড়ে, আদালতে এসে দোতরফা নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করে।’
কিন্তু কেউ তো মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলার জন্যেও আদালতের সমন রিসিভ না করে এড়িয়ে চলতে পারেন, কারণ পরে দোতরফা নিষ্পত্তির জন্য আদালতে আবেদন করা যাবে- বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে বাদীর উচিত হবে আদালতের আদেশ বিবাদীকে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে পাঠানো।
যেমন- মেসেজ, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি। তাহলে একতরফা রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদী আবেদন করলে তিনি তা আদালতকে অবহিত করতে পারবেন যে সময়ে সময়ে বিবাদীতে এসব বিষয় তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় তথ্য পাঠানো হয়েছিল, তিনি তা দেখেছেন, কিন্তু এখন আদালতকে অসত্য তথ্য দিয়ে মামলাটিকে দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলতে চান। তাতে আদালতের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ধরুন, আপনি একজনকে একটা চেক দিয়েছেন, কিন্তু চেক ডিজঅনার হয়েছে। এখন এই টাকা তো আপনাকে পরিশোধ করতে হবে। এই অবস্থায় চেক ডিজঅনার মামলা হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো তেমন কিছু এলে, আপনার হাতে তো নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকে আদালতের ডাকে সাড়া না দিয়ে চুপ করে থাকেন। তখন মামলাটি একতরফা নিষ্পত্তির দিকে যায়। পরবর্তী সময়ে সেকশন-১৯-এর অধীনে আবেদন করে। তখন আবার দোতরফা নিষ্পত্তির দিকে মামলা এগোয়। এতে করে মূলত দেনা পরিশোধে সময়ক্ষেপণ করা যায়।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে আইন পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (লিগ্যাল কনসালট্যান্সি ফার্ম) ‘সাত্তার অ্যান্ড কোং’-এর প্রধান সামির সাত্তার বলেন, ‘এমন কেউ তো থাকতেই পারেন, যিনি সত্যিই কোনো কারণে আদালতের আহ্বানে সাড়া দিতে পারেননি বা আদালতের নির্দেশ তার কাছে পৌঁছায়নি।
তাই তার জন্য তো একতরফা রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করার সুযোগ থাকতে হবে। না হলে তো তার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। আর আইন তো সবার জন্যই সমান, সবাই আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তাই অন্য কেউ ভুক্তভোগী না হয়েও এই সুযোগ নিয়ে মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় ফেললেও আপাতত কিছু করার নেই।’
বহুল আলোচিত-সমালোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি পরিচালনার জন্য ২০২১ সালে কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্যাংকিং ও কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রধান যেসব বিষয় অধস্তন আদালতকে মোকাবিলা করতে হয়, সেগুলো নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রায় সব বিষয়েই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে বিষয়গুলো ওয়েল সেটেল্ড। মামলার পক্ষগুলোও আসলে জানে, এই মামলার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। তাই কেউ কেউ একটা অপকৌশলের আশ্রয় নিতে পারে যে মামলায় আদালতের আহ্বানে সাড়া না দেওয়া। তাতে করে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে মামলাটি একতরফাভাবে হলেও আদালতকে নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু একতরফাভাবে নিষ্পত্তি হলে এর বিরুদ্ধে আবার আদালতে আবেদন করা যাবে। এতে করে মামলাটি দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলা যায়, অর্থাৎ দেনা পরিশোধে আরও সময়ক্ষেপণ করা যায়। এক কথায় বলতে গেলে, মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলার অপকৌশল হিসেবে কেউ এটা করতে পারেন।’