১০ বছর আগেও চট্টগ্রাম-৪ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এস এম আল মামুনকে সীতাকুণ্ড জনপদে চিনত হাতে গোনা কিছু লোক। তার বাবা মরহুম আবুল কাশেম মাস্টার ছিলেন ওই আসনের সাবেক এমপি ও সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি।
আল মামুন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের তেমন কোনো বড় নেতা না হয়েও তার বাবার কল্যাণে উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। এরপর থেকেই দলে মামুনের বন্দনা বাড়তে থাকে। শুরু থেকেই মামুন জনপ্রিয়তার বদলে দখলদার ও ক্যাডার বাহিনীর গডফাদার হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। ২০১৪ সালে একতরফা কারচুপির নির্বাচনে তিনি সর্বপ্রথম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। এরপর মামুনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যেদিকে চোখ গেছে শুধু দখল আর দখলের সাম্রাজ্য গড়েছেন তিনি। হিন্দুদের শ্মশান, সরকারি জমি, বন, অসহায় মানুষের জমি কোনোটিই দখলে নিতে বাদ রাখেননি। ২০১৯ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের হাফ ডজন নেতাকে পেছনে ফেলে উপজেলা চেয়ারম্যানের আসন দখল করেন। মাত্র ১০ বছরের ফ্রন্টলাইন রাজনীতিতে তিনি হয়েছেন টাকার কুমির। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন মামুন। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ও আদালতে হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকেন্দ্রিক হত্যা মামলা।
কীভাবে মামুন টাকার কুমির হয়েছেন তা অনুসন্ধান শুরু করে খবরের কাগজ। তাতে উঠে এসেছে ভয়ংকর চিত্র। জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মামুন এমপি হলেও সময় পেয়েছেন মাত্র সাত মাস। এ কারণে অনেকেই বলেছেন, সুযোগের অভাবে এমপি হিসেবে মামুন তেমন সম্পদ গোছাতে পারেননি। মূলত, এক দশক উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালেই সব সম্পদ গড়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে আল মামুনের তিনটি নির্বাচনি হলফনামা আমাদের হাতে এসেছে। সেগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিগত সরকারের শেষ ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ। ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে কক্সবাজারে বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল গড়েছেন তিনি। এ ছাড়া আছে একাধিক শিপইয়ার্ড, হোটেল, মোটেল, মদের বার, ট্রাক টার্মিনাল, ফিশিং ট্রলার, অভিজাত খুলশীতে বাড়িসহ নামে-বেনামে অসংখ্য ব্যবসা-বাণিজ্য। তিনি এসব গড়েছেন অবৈধ উপায়ে।
নির্বাচনি হলফনামায় মামুনের সম্পদ
আল মামুন ২০১৪ উপজেলা নির্বাচনে কাপ-পিরিচ মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিতর্কিত ও অংশগ্রহণবিহীন ওই নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথমবারের মতো জনপ্রতিনিধি হন তিনি। সেবার তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেন, তার নামে কোনো বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নেই। একই তথ্য তিনি ২০১৯ সালের ১৫ মার্চের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময়ও ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হফলনামা তিনি উল্লেখ করেছেন, তার নামে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার ভবন আছে। অর্থাৎ চার বছরে তিনি এই সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে তিনি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য দেখিয়েছেন ৭০ লাখ টাকা। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেটি কমিয়ে দেখান ৬২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
আবার ২০১৪ সালে নিজ নামে অকৃষি জমি ও অর্জনকালীন মূল্য দেখিয়েছেন ৫১ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫০ টাকা, ২০১৯ সালে দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে দেখিয়েছেন ৮৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০ টাকা।
১৪ সালে তার স্ত্রীর নামে কোনো অকৃষি জমি না থাকলেও ২০১৯ সালে এসে তার নামে হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার সম্পদ, যা ২০২৪ সালেও একই দেখানো হয়েছে। এতে বোঝা যায়, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালে মামুনের সম্পদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আগের দুবার তিনি কৃষিজমি না দেখালেও ২০২৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায় দেখিয়েছেন ২ কোটি ৪৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
২০১৪ সালে মামুনের বন্ড শেয়ার, ঋণপত্র ও কোম্পানির শেয়ার দেখিয়েছেন ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, যা তিনি ২০১৯ সালেও একই রেখেছেন। ২০১৪ সালে মোট স্থাবর ও অস্থাবর মিলে মোট সম্পদ ছিল ১ কোটি ৮৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫০ টাকার। আর ওই বছর ব্যক্তিগত ও ব্যাংক লোন মিলে ঋণ দেখিয়েছেন ৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে আয় দেখান ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হাজার। তিনি ও তার স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পতি দেখান ৫ কোটি ৭৮ লাখ ২২ হাজার টাকার। তবে ২০২৪ সালে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক গুণ। এতে তার নামে আয় আছে ১ কোটি ৮০ লাখ ২৩ হাজার। আর অস্থাবর সম্পত্তি আছে ৬ কোটি ২৬ লাখ ১৪ হাজার ২১২ টাকা। আর স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পত্তি আছে ৭ কোটি ৭২ লাখ ৮ হাজার টাকার। অথচ ২০১৯ সালে তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার। ৫ বছরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৭ গুণ।
এ ছাড়া ২০২৪ সালের হলফনামায় মামুনের স্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে ২৯ কোটি ৮২ লাখ ২২ হাজার ৩৬৫ টাকার। অথচ ২০১৯ সালে তার স্থাবর সম্পদ ছিল ৮৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০ টাকার। অর্থাৎ কেবল পাঁচ বছরে তার স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২৮ গুণের বেশি। আশ্চর্যজনকভাবে ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে তিনি যথাক্রমে ৯ কোটি, ৯ কোটি ৯২ লাখ ও ১০ কোটি ৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ঋণ দেখিয়েছেন ব্যক্তি ও ব্যাংক লোন হিসেবে।
এস এম আল মামুন নির্বাচনি হলফনামাও ছলচাতুরী করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তার স্ত্রীর নামে দেখানো বেশির ভাগ সম্পত্তিই তার বলে গুঞ্জন উঠেছে। সচেতন রাজনৈতিক মহলের মতে, আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতার সম্পদের অনুসন্ধান করা জরুরি। দেশে ও বিদেশেও তার অনেক সম্পত্তি রয়েছে।
কক্সবাজারে বিলাসবহুল হোটেল
২০১৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচে মোটা অঙ্কে জমি কেনেন মামুন। এ জন্য তিনি মিরসরাইয়ের সাবেক এমপি রুহেলের সহযোগিতা নেন। এরপর সেখানে তিনি অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল ‘গ্রিন ন্যাচার রিসোর্ট অ্যান্ড সুইটস’ তৈরির কাজ শুরু করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি সেই রিসোর্টের উদ্বোধন করেন। ওই সময় সীতাকুণ্ড থেকে দলীয় কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে সেখানে ভোজের আয়োজন করেন। সেই সময় তিনি তার ফেসবুকে লেখেন, ‘কক্সবাজারে আমার হোটেল উদ্বোধন করা হলো।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামুন যেই মানের রিসোর্ট গড়েছেন সেটি নির্মাণ করতে বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকার মতো খরচ হতে পারে। এত বিলাসী হোটেল তৈরির জন্য তার এই টাকার উৎস কী, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। চট্টগ্রাম মহানগরের ফিনলে স্কয়ারে মামুনের নামে আছে দুটি দোকান। এ ছাড়া দুটি শিপইয়ার্ড এবং ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা আছে মামুনের।
বন ও পাহাড় দখলে মামুন
২০২২ সালে মামুন সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায় নড়ালিয়া মৌজায় উপকূলীয় বন বিভাগের ৫ একর জমি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ও খুঁটি গেড়ে দখল করেন। ওই সময় একটি গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তিনি ২ সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দিয়ে চরম হয়রানি করেন। সে সময় বন বিভাগ তাকে দখল ছেড়ে দিতে নোটিশ করলেও তিনি বিষয়টিকে পাত্তাই দেননি। উল্টো বন কর্মকর্তাদের ধমকানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
এর আগে ২০০৮ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামুনের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা সোনাইছড়ি উপকূলে হাজার হাজার গাছ কেটে দুটি শিপইয়ার্ড গড়ে তোলেন। এ ঘটনায় তখন কোনো থানায় মামলা হয়নি। পরে বন বিভাগ আদালতে মামুনসহ ১৩ জনের নামে মামলা করে। ওই মামলায় মামুন ২ নম্বর আসামি। এ ছাড়া উপজেলার জঙ্গল ছলিমপুরে মামুন ও তার ছোট ভাই এস এম আল নোমানের দখলে রয়েছে ১০ একর পাহাড়। সেখানে তার বিরুদ্ধে আছে ভূমিহীনদের কাছে সরকারি জমি প্লট আকারে বিক্রি ও একই প্লট একাধিকবার বিক্রির অভিযোগ।
অন্যের জমি দখল করে ট্রাক টার্মিনাল
অভিযোগ আছে ফৌজদারহাটের আউটার লিংক রোড়ে কাট্টলী মৌজায় বিশাল আকৃতির জমি দখল করে সাগর থেকে বালু তুলে ভরাট করেন আল মামুন। তবে তিনি প্রভাবশালী হওয়াতে এখনো তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলছেন না। সেখানে তিনি এসএম ট্রাক টার্মিনাল নামে একটি ট্রাক ইয়ার্ড গড়ে তোলেন। এ ছাড়া ফৌজদারহাটে বাইপাসের মুখে মোবারক হোসেন নামে ঢাকার এক বাসিন্দার জায়গা দখল করে ট্রাক টার্মিনাল করেন মামুন। প্রায় ১৫ বছর সেই জমি দখলে রাখেন তিনি।
পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞে মামুন
পরিবেশ হুমকির মুখে ফেলে বিনা অনুমতিতে অবৈধভাবে সাগর থেকে বালু উত্তোলন করেন মামুন। এ জন্য ২০২২ সালের ২৪ মার্চ তাকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মুফিদুল আলম এ জরিমানা করেন। সে বছর পরিবেশ অধিদপ্তর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামুনের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করার প্রমাণ পায়।
কাজ না করেই কোটি টাকা উত্তোলন
জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে কোনো প্রকার কাজ না করেই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর থেকে এক কোটি টাকা তুলে নেন আল মামুন। তার পিএস সাইদুর রহমান মারুফ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছ থেকে ওই টাকা তুলে নিয়ে যান। জানা গেছে, প্রত্যেক আসনের এমপিদের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থোক বরাদ্দ দিয়েছিল ২ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে নিজ দায়িত্বে এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ নির্মাণ বা উন্নয়ন করতেন পারেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু মামুন কোনো উন্নয়ন না করেই টাকা তুলে নেন। টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জামিরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘উন্নয়ন কাজের কিছু ছবি তিনি আমাদের দিয়েছেন।’ তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়ে টাকাটা তুলে নিয়ে যান। তবে সেসব ছবি প্রতিবেদককে পাঠাতে বললেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মামুন
এস এম আল মামুন একসময় যুবলীগের উত্তর জেলার সভাপতি থাকলেও ২০১৯ সালে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে চেয়ে হয়ে যান সাধারণ সম্পাদক। এরপর থেকে দলে মামুন বন্দনা ও প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তিনি। ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি নৌকার মনোনয়ন পান। মামুন তার রাজনীতির সুবিধার্থে গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। তিন হত্যা মামলার আসামি সাইদুল ইসলাম, নিহত দাউদ সম্রাট, শাহাজাহান, বদিউল আলম জসিম, রবিউলসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন তিনি। তার ছিল একক আধিপত্য। তার ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসীরা সীতাকুণ্ডে মানুষকে জিম্মি করে রাখতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে মামুন আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরও তার অপকর্ম নিয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক এমপি এস এম আল মামুনের মোবাইলে একাধিক ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।