মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বাতিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
রেলওয়ে নেটওয়ার্ক পরিচালনায় দক্ষতা নেই। অথচ মেট্রোরেলের মতো বিশেষায়িত গণপরিবহনব্যবস্থায় শীর্ষ কর্তা হয়ে ৭ বছরের বেশি সময় ডিএমটিসিএলে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এই সাবেক সচিব।
গতকালই নতুন এমডির দায়িত্ব পেয়েছেন আবদুর রউফ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিবের পদে ছিলেন।
এম এ এন ছিদ্দিকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
দ্য কোম্পানিজ অ্যাক্ট-১৯৯৪-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে মেট্রোরেল পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএলের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম করেছেন।
এ অ্যাক্টের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এখনো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্ভিস রুল না করায় বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ডিএমটিসিএলের অধস্তন কর্মচারীদের (দশম থেকে বিশতম গ্রেড) মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মেট্রোরেল চালু করা যায়নি অধস্তন কর্মচারীদের বিক্ষোভের কারণে। বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার দাবিতে তারা কর্মবিরতির ঘোষণা দিলে মেট্রোরেল পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে ডিএমটিসিএল। অধস্তন কর্মচারীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তা কবে নাগাদ সুরাহা হবে নিশ্চিত নন শীর্ষ কর্মকর্তারাই।
অভিযোগ রয়েছে, এম এ এন ছিদ্দিক ডিএমটিসিএল পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব খাটিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিনা নোটিশে সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিএমটিসিএলে শুরু থেকেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের তথ্য উত্থাপিত হয়েছে নানা সময়ে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে এ নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও ডিএমটিসিএল এমডি এম এ এন ছিদ্দিক প্রভাব খাটিয়ে সেসব তথ্য ধামাচাপা দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগকে পাশ কাটিয়ে এম এ এন ছিদ্দিক সরাসরি যোগাযোগ করতেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিশেষ অনুকম্পা’ পেয়ে তিনি ডিএমটিসিএলে একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
১৯৮২ সালের বিশেষ বিসিএস ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএমটিসিলের সর্বপ্রথম কমিটির পরিচালক বুয়েট অধ্যাপক ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা বিশেষায়িত সেবাটি পরিচালনার জন্য অন্তত ২০ বছরের রেলওয়ের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল।
কিন্তু এম এ এন ছিদ্দিক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে অবসরে যেতে না যেতেই ২০১৭ সালে প্রভাব খাটিয়ে এমডি হন। শুধু তাই নয়, গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক পদে তিনি এমন সব ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের কোনো কারিগরি জ্ঞানই নেই। আমরা যখন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় অবকাঠামোগত খাতকে আরও বেশি টেকসই ও গুণগত মানসম্পন্ন করার কথা বলছি, তখন এসব ঘটনার সুরাহা না হলে তা উন্নয়নে বিরাট বাধা হয়ে উঠবে।’
অধ্যাপক শামসুল হক জানান, মেট্রোরেলের বোর্ড অব ডিরেক্টরস সদস্যদের খেয়ালখুশিমতো নিয়োগ দিয়েছেন এম এ এন ছিদ্দিক। কখনো প্রভাব খাটিয়ে প্রকৌশলী ও অধ্যাপকদের বাদও দিয়েছেন।
শামসুল হক আরও বলেন, এমন কিছু লোককে এখানে পরিচালনার দায়িত্বে রাখা হয়েছে, যাদের আসলে রেলভিত্তিক সেবা প্রদানের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। এসব অনিয়মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
রাজধানীর যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল সেবা চালুর জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালের ৩ জুন ডিএমটিসিএল গঠন করে। এটি ২০১৮ সালে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মে নিবন্ধিত হয়। সেই মোতাবেক কোম্পানির গঠনতন্ত্র, কর্মপরিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত তথ্য প্রণয়ন করার নিয়ম রয়েছে, যাকে আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন (এওএ) বলা হয়।
মেট্রোরেল পরিচালনা পর্ষদে আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন প্রণয়নের চাপ থাকলেও ডিএমটিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা তা করেননি।
এতে সবচেয়ে বড় যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়ে। কোম্পানির নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক কত দিন এ প্রতিষ্ঠানে থাকবেন, সে সময়সীমা নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু এম এ এন ছিদ্দিকের নিয়োগপত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছেন ড. শামসুল হক।
এ অনিয়ম প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল এমডি এম এ এন ছিদ্দিক গত ২ সেপ্টেম্বর খবরের কাগজকে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করিনি। আমার নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও সব ধরনের নিয়ম মানা হয়েছে। সরকার আমাকে যোগ্য মনে করেছে বলেই তো আমি আজকে এত দিন মেট্রোরেল, ডিএমটিসিএল সামলে যাচ্ছি।’
আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন না হওয়ায় মেট্রোরেলের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ডিএমটিসিএলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ নবায়নেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) আইন-২০১২-এর অধীনে গঠিত ডিএমটিসিএল-এর ৬৪ শতাংশের বেশি শেয়ার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের। অন্য শেয়ারহোল্ডাররা হলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ-জ্বালানি-খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ডিটিসিএ।
এসব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বুয়েটের একজন শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের একজন প্রতিনিধিও ডিএমটিসিএল-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিচালনা পর্ষদের দুজন সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, পরিচালনা পর্ষদে মেট্রোরেল নিয়ে কারও কোনো আপত্তি আমলেই নেননি এম এন ছিদ্দিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বলে তিনি অনেক অনিয়ম করে পার পেয়ে গেছেন।
পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আমাকে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ দেওয়ার সময় বলা হলো, আমি তিনটি সভায় অনুপস্থিত ছিলাম। অথচ সভা যে হয়েছে, তা আমাকে ফোনে বা চিঠিতে কোনোভাবে জানানো হয়নি। আমাকে বাদ দেওয়ার আগে শোকজ নোটিশও দেওয়া হয়নি। মেট্রোরেল এমডি আমাকে বাদ দেওয়ার পর বুয়েট থেকে আরেকজন পরিবহন বিশেষজ্ঞের নাম চেয়ে আবেদন জানায় ডিএমটিসিএল। তখন বুয়েট থেকে আবার আমার নামই প্রস্তাব করা হয়। পরে আমি আর রাজি হইনি।’
মেট্রোরেলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জাইকার পরামর্শ ছিল, অন্তত ১৫-২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশল জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের মাধ্যমে যেন মেট্রোরেল পরিচালনা করা হয়। কিন্তু মেট্রোরেল পরিচালনায় অনেক কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন এম এ এন ছিদ্দিক, যাদের কারিগরি দক্ষতা নেই।
এমন অনিয়ম করায় ডিএমটিসিএলে অনেক দক্ষ প্রকৌশলী কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। এ কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও গভীর রাত পর্যন্ত এমআরটি-৬-এ মেট্রোরেল গভীর রাত পর্যন্ত পরিচালনা করা যায়নি।
এম এ এন ছিদ্দিকের নিয়োগের বিষয়ে জানতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সদ্য সাবেক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে খবরের কাগজ। তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটি সচল থাকলেও তিনি ধরেননি।
সচিবের পদ হারানোর পরে তিনি কারও ফোন ধরছেন না বলে জানিয়েছেন সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। সড়ক পরিবহন-মহাসড়ক বিভাগের বর্তমান সচিব ও মেট্রোরেল পরিচালনা পর্ষদের প্রধান মো. এহসানুল হককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
ডিএমটিসিলের নানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমি মেট্রোরেলের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে এখনো কিছু জানি না। নিয়োগে অনিয়ম হয়ে থাকলে আমি খবর নিয়ে দেখব।’