ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গড়িমসি এবং ভারত থেকে প্রযুক্তি পণ্য আমদানিতে জটিলতা তৈরি হওয়ায় নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুতে কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বা কম্পিউটারবেইজড ইন্টারলিংক সিস্টেম (সিবিআইএস) চালু করা যাচ্ছে না। এতে সনাতন পদ্ধতির নন-ইন্টারলিংক ব্যবস্থায় ট্রেন পরিচালনা করতে হবে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে। কারিগরি এই ত্রুটি নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এখন যমুনার বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে মিটারগেজের যে রেলসংযোগ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৭০ কিলো-নিউটন/মিটার ওজন বহনের অনুমতি রয়েছে। ট্রেনে বেশি বগি যুক্ত করার সুযোগ নেই, সঙ্গে রয়েছে এক লাইনের সীমাবদ্ধতা। এই সেতুতে ঘণ্টায় মাত্র ২০ কিলোমিটার গতিতে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার সেতু পার হতে একেকটি ট্রেনের ২৫ মিনিটের মতো সময় লেগে যায়। সেতুর ওপর একটি লাইন হওয়ায় দুই পাড়ের স্টেশনে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে দীর্ঘসময়। সবমিলিয়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগছে এক ঘণ্টার বেশি।
এই দুর্ভোগ থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে বিগত সরকার ২০২০ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকের ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা এবং জাপানের জাইকা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করে।
সেতুটির প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ডব্লিউডি-১ ও ডব্লিউডি-২ নামে দুটি প্যাকেজে জাপানি পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ডব্লিউডি-১ প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করছে জাপানি আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওবাইসি, টোআ করপোরেশন ও জেইসি (ওটিজে) জয়েন্ট ভেঞ্চার। সেতুর উভয় প্রান্তের দুই স্টেশনে সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপনে ডব্লিউডি-৩ প্যাকেজের কাজ করছে জাপানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইয়াশিমা।
জানা গেছে, নতুন এই রেলসেতুতে সিবিআইএস চালু করতে ইয়াশিমা প্রযুক্তি পণ্য কিনছে জাপানি প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিটাচির কাছ থেকে। ভারতে হিটাচির পণ্য উৎপাদন কারখানা থাকায় ইয়াশিমা সেখান থেকেই পণ্য আমদানি করছিল। ঠিকাদাররা এখন সেখান থেকে পণ্য আমদানি করতে কিছু জটিলতায় পড়েছেন। জটিলতা নিরসনে রেলওয়ে ঠিকাদারদের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক আবুল ফাত্তাহ।
গতকাল মঙ্গলবার তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইয়াশিমার সঙ্গে আমাদের শিগগিরই একটা সভা আছে। তারা কবে নাগাদ সিবিআইএস চালু করতে পারবে তা আমাদের জানাবে। যদি তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারে তাহলে দুই-এক মাস বাড়তি লাগতে পারে। হিটাচি থেকে যদি মেটেরিয়াল আরও আগে আসত, তবে কাজ শেষ পর্যায়ে যেত। এখন মেটেরিয়াল কোনটা আগে আসবে সেটি উল্লেখ করে ইয়াশিমা ফিজিক্যাল ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান সাবমিট করবে।’
নতুন এই রেলসেতু দিয়ে ব্রডগেজ ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার ও মিটারগেজ ট্রেন ১০০ কিলোমিটার গতিতে পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সিবিআইএসের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৪০ শতাংশ। সেতু চালু হওয়ার পরে আরও দুই-তিন মাস সময় লাগতে পারে সিবিআইএস চালু করতে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় প্রকল্প পরিচালক বলেন, সিবিআইএস চালু না হওয়ায় মূল সেতুতে নয়, রেলের গতি কমবে সেতুর কানেক্টিং দুই স্টেশনে। নন-ইন্টারলিংক সিস্টেম চালু থাকায় স্টেশনের লুপ লাইনে যখন ট্রেন প্রবেশ করবে, তখন তার গতি কমিয়ে আনতে হবে ১৬ কিলোমিটারে। তবে লুপ লাইন পেরিয়ে মূল সেতুতে রেল ফুল স্পিডে চলাচল করতে পারবে। রেললাইন ও ব্রিজের সক্ষমতা রয়েছে।’
সিবিআইএস চালু না হলে পশ্চিমাঞ্চলের পথে রেলওয়ের নিরাপত্তা ইস্যুতে শঙ্কা থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অবকাঠামোগত নির্মাণের সঙ্গে সিগন্যাল সিস্টেমকে কম্পিউটারবেইজড ইন্টারলিংক সিস্টেমে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য, রেলের গতি বাড়িয়ে শিডিউল বিপর্যয় হ্রাস করা; যদি নন-ইন্টারলিংক সিস্টেম চালু থাকে তাহলে সেখানে যাত্রীসেবার মান বিন্দুমাত্র বাড়বে না। উপরন্তু এতে করে রেলপথে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।’
যমুনার পুরোনো সেতু দিয়ে বর্তমানে দিনে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করছে। নতুন সেতু চালুর পরে আন্তনগর, লোকাল, কমিউটার ও মালবাহী ট্রেনসহ ৮৮টি ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল রেলওয়ে। তবে সেই বাস্তবতা নেই রেলওয়েতে। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু চালুর পরে উত্তরাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের পথে নতুন কোনো ট্রেন চালু করা যাবে কি না, জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘নতুন কোনো ট্রেন চালু করা হলে সেটি আমরা জয়দেবপুর, টঙ্গী পর্যন্ত চালাতে পারব। কারণ ঢাকায় রেলের থার্ড লেন ও ফোর্থ লেনের কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। ঢাকার সক্ষমতা তৈরি না করে এখন নতুন ট্রেন কোনোভাবেই আমরা চালাতে পারব না। তবে এটা ঠিক যে উত্তরাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথে আরও দুই-তিনটি ট্রেনের চাহিদা রয়েছে।’
জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এ বছরের আগস্টের মধ্যে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নির্মাণকাজ সমাপ্তির কথা ছিল। প্রকল্প সংশোধনের জন্য নির্মাণকাজ শেষে আরও এক বছরের বাড়তি সময়সীমার কথাও চুক্তিতে উল্লেখ করা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর ভৌত অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ দশমিক ২৪ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ১১ হাজার ৪৩৫১ কোটির বেশি। প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পে রেলওয়ে বড় অঙ্কের টাকা সাশ্রয় করতে যাচ্ছে। প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শেষ হলে আমরা তা হিসাব করে জানাব।’
বঙ্গবন্ধু রেলসেতু চালু হওয়ার পরে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলছে রেলওয়ে, সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগ চালু হওয়ার পরে অর্থনীতি যতটা চাঙা হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হয়নি। রেলওয়ে সংযোগে অর্থনীতির ফ্রিকোয়েন্সি অতটা দেখতে পাইনি আমি। আমি বলব, এখানে রেলওয়েকেন্দ্রিক শিল্প অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সেই চিরাচরিত পদ্ধতিতে সড়কপথেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর সঙ্গে উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের ইপিজেড, স্থল বন্দর, নৌ-বন্দরগুলোর সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে রেলওয়েকে। তাহলে রেলওয়ের বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে।’
এদিকে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণের পরে ভূমি হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। নতুন এই রেলসেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) জমিতে। এখন রেলওয়ে সেই জমিটি রেলের সম্পত্তি হিসেবে নিতে চায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে। ভিত্তিমূল্যে জমিটি রেল বিভাগের কাছে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে এই চিঠিতে। বিবিএ ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী বাজার মূল্য ছাড়া এই জমিটি হস্তান্তর করতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন এ সেতুর প্রকল্প পরিচালক। রেলওয়ে বিষয়টি সমাধানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনো ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো চিঠি পাইনি। তবে জমি অধিগ্রহণ ইস্যুতে রেলসেতু নির্মাণ বা রেল চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না।’
বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করতে পরিবেশ অধিদপ্তর বঙ্গবন্ধু ইকোপার্কে একটি সার্ভে পরিচালনা করেছিল। এতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ৩ হাজার ৬৮৩টি গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় উদবিড়াল, শিয়াল, বাংলা গুইসাপ, সোনালি গুইসাপ ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন-আইইউসিএনের লাল তালিকাভুক্ত বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন এই প্রকল্প এলাকায় আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জেনারেটর ব্যবহার, পরিবহন যানবাহন বৃদ্ধি ও আবাসিক ভবন নির্মাণের কারণে বাতাসের গুণগতমানের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘আমরা প্রকল্প এলাকায় ৫৫ হাজার বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছি। ইতোমধ্যে ২৫ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের জন্য আন্ডারপাস নির্মাণ করেছি।’