বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় ১৬ বছর ধরে কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। এতে তেমন কোনো সফলতা আসেনি। তবে লবিস্ট নিয়োগ করে ২০১২ সালে ১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনা হয়েছে। অবশ্য এ জন্য লবিস্টকে দিতে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এখনো এমএলআরের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
এর পাশাপাশি পাচারের টাকা ফেরাতে এবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই), জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তরের (ইউএনওডিসি) এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে দুদক। এ নিয়ে গত সোম ও মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এফবিআই ও ইউএনওডিসির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পৃথক বৈঠক হয়েছে। আইএমএফের সঙ্গে কয়েক মাস আগেও দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই তাদের সঙ্গে আবারও বৈঠক হতে পারে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে ইউএনওডিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান মারকো টেক্সাইরার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখা ও লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিনিধিদলটি দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এর আগের দিন সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অ্যাসিস্ট্যান্ট লিগ্যাল অ্যাটাশে রবার্ট ক্যামেরনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দুদকের একই কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আঞ্চলিক প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এসে মানি লন্ডারিং শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়। প্রতিনিধিরা দুর্নীতি প্রতিরোধে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কী কী করা যায়, সেসব নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করে পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, প্রতিনিধিদলগুলো ফিরে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বাংলাদেশের অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তাব পাঠাবে বলে জানিয়েছে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে এফবিআইসহ বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকের বিষয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তাদের (এফবিআই ও ইউএনওডিসি) কাছ থেকে পাওয়া যাবে। তারা দুদককে এ ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধরনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। এমএলএআর পাঠানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে এবং এর জবাবও আসে একই মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় ওই সময় কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে এমএলএআর পাঠায় দুদক। এর পাশাপাশি পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে ২০০৮ সালের শেষ নাগাদ তৎকালীন দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ খানকে কিছু দায়িত্ব দেন দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী। কিন্তু ওই সময়ে কোনো সফলতা আনতে পারেননি ফেরদৌস। সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হন ফেরদৌস আহমেদ খান।
এ সময় তিনি দুদকের কাছে আবেদন করেন যে তাকে লবিস্ট নিয়োগ করা হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা ১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ফেরত আনতে সহযোগিতা করতে পারবেন। এ জন্য তিনি রিওয়ার্ড হিসেবে ৩০ শতাংশ টাকা দাবি করেন। দুদক আইনে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। তবুও পাচারের টাকা ফেরত আনার জন্য দুদক সে সময় ফেরদৌসের প্রস্তাবে রাজি হয়। অবশেষ ২০১২ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা দুদকের অ্যাকাউন্টে ফেরত আসে। শর্ত অনুসারে একই বছরের ২২ নভেম্বর ফেরদৌসের অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেয় দুদক।
এরপর আর কোনো লবিস্ট নিয়োগের তথ্য জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন দেশে এমএলএআর পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। ২০১৩ সালে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনিসহ দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, হংকং ও কানাডার কাছে এমএলএআর পাঠানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জবাব ও তথ্য-উপাত্ত এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবু হাল ছাড়েনি দুদক। চেষ্টা অব্যাহত আছে।
এদিকে ভারতে পি কে হালদারের টাকা পাচারের ঘটনায় হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে দেশে অর্থ পাচার আইনে পাঁচ বছরে (২০১৬ থেকে ২০২০) কতটি মামলা হয়েছে এবং কতজনকে আসামি করা হয়েছে, সেসবের তালিকা চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা অনুযায়ী, সে সময় প্রতিবেদন আকারে একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক। প্রতিবেদনে ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অর্থ পাচার আইনে ১৩৫টি মামলা দায়েরের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ৪৭টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল এবং বাকি ৮৮টি মামলা তদন্ত চলমান থাকার কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনে অর্থ পাচার মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বহিষ্কৃত কর্মচারী আবজাল, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধার খাজা সোলায়মান ও তার স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আলম, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ, ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, শাহরিস কম্পোজিট টেক্সটাইলের এমডি খাজা সোলেমান আনোয়ার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান, যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঠিকাদার জি কে শামিম, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ইসমাঈল হোসেন সম্রাট, ক্যাসিনো সেলিম, এনটেক্সের কর্ণধার ইউনুস বাদল, এমএম ভেজিটেবলের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক, ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাবুল চিশতি ও তার ছেলে, ভোলার সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিম, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি পাপুল, এনসিসি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান, লর্ড ভিশনের চেয়ারম্যান হোসাইন মাহমুদ রাসেল, পুলিশ পরিদর্শক ফিরোজ কবীর, ডিএমপির হুমায়ুন কবীর বাতেন, সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম, ইলিয়াস ব্রাদার্সের এমডি শামসুল আলম, ইটিভির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, সাবেক এমডি আশরাফুল আলম, সাবেক কর্মকর্তা ফজলুর রহমান সিকদার, টেলিটকের সাবেক ম্যানেজার শাহ মোহাম্মদ যোবায়ের, প্যারাডক্স ফার্মাসিউটিক্যালসের সাবেক এমডি রকিবুল হাসান রাজন, আমানত স্টিলের এমডি হারুনুর রশীদ, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, এএমসি টেক্সটাইলের সাবেক চেয়ারম্যান চাঁদ মিয়া, আইন কমিশনের ড্রাইভার শামসুল আলমের নাম উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্তরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
দুদকের একজন পরিচালক খবরের কাগজকে জানান, ২০২১ থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে শতাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। অর্ধশতাধিক মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসবের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে।