যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর উপজেলা ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনের তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায় আওয়ামী লীগের শাসন আমলে অবৈধভাবে কয়েক শ কোটি টাকা কামিয়েছেন। এমপি হওয়ার আগে আধা পাকা ঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও বিস্তর জমির মালিক হয়েছেন। এমপির পদ ছিল তার জন্য আলাদিনের চেরাগ।
সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব উল্লেখ করছেন, সেই হিসাব অনুযায়ী ১৫ বছরে রণজিত রায়ের ১৩৩ গুণ ও স্ত্রী নিয়তি রায়ের ২৬৩ গুণ সম্পদ বেড়েছে। বাস্তবে রণজিত ও তার স্বজনদের সম্পদ বেড়েছে হাজার গুণ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনি। রণজিত ও তার পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দুদকের
রণজিত কুমার ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যশোরের দুদক কার্যালয় থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে, তার ছেলে রাজিব কুমার রায় প্রতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি কাজের জন্য ৫ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন। তার নিজ ও ছেলের নামে ভারতের সল্টলেক এলাকায় বাড়ি রয়েছে। এই এমপির পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জমি দখল, মানিলন্ডারিং, নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজিসহ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন।
নিয়োগ-কমিশন বাণিজ্য ও দখলদারিত্ব
সাবেক এমপি রণজিত কুমার রায়ের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বাণিজ্য। রণজিত কুমার রায়, স্ত্রী নিয়তি রানী এবং দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়োগ-বাণিজ্য করার জন্যই তারা সভাপতি হতেন বলেও অভিযোগ আছে। টানা ১৫ বছর সংসদ সদস্য থাকায় একচেটিয়া নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন রণজিত।
২২ লাখ টাকার বিনিময়ে বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে হাবুল্যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ৩২ লাখ টাকার বিনিময়ে রায়পুর কলেজের অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ধলগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে আগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাতিয়ানতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে খাজুরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ, ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে অভয়নগরের বিসিসি মুজহিদা মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার প্রত্যেকটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হতো রণজিত কুমারকে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী, স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্যে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। দুই উপজেলায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ও কলেজ সরকারিকরণের নামে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন রণজিত।
অবৈধ টাকা আয়ের আরেকটি উৎস ছিল টেন্ডার-বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন গ্রহণ। রণজিত রায়ের পক্ষে টেন্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন স্থানীয় দুই পৌরসভার মেয়র ও এক শ্রমিক নেতা।
রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে দলের নেতা-কর্মী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি জোরপূর্বক ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের অভিযোগ রয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক হাসান আলীকে (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাইয়ে দিয়ে ৫ বিঘা জমি তার অনুসারীর নামে লিখে নেন তৎকালীন এমপি রণজিত কুমার। তবে নির্বাচনে পরাজিত হন হাসান আলী। এরপর চাপে পড়ে সেই জমি হাসান আলীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন রণজিত রায়।
বন্দবিলা ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, খাজুরা শ্মশানের জমি কেনার কথা বলে হিন্দুদের কাছ ১ কোটি টাকা চাঁদা তুলে ৪২ শতক জমি নিজের নামে লিখে নেন রণজিত। বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামের সুশীল মল্লিকের ১২ বিঘা জমি জোরপূর্বক লিখে নিয়েছেন রণজিত রায়। ভুক্তভোগী সুশীলের স্ত্রী অনিমা মল্লিক ভয়ে এখনো এলাকা ছাড়া রয়েছেন। এ ছাড়াও ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সরকারি ও খাস জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে রণজিতের বিরুদ্ধে।
নামে-বেনামে যত সম্পদ
নবম, দশম ও একাদশ সংসদে যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন রণজিত কুমার রায়। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় রণজিত রায়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল সাকল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। এর মধ্যে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১ লাখ টাকা মূল্যের ৪ বিঘা জমি, খাজুরায় ৪ শতক জমির ওপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর।
বার্ষিক আয় ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী নিয়তি রানীর নগদ ৭০ হাজার টাকা, ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। আয়ের কোনো উৎস ছিল না। ১৫ বছরের ব্যবধানে রণজিত-নিয়তি রানী দম্পতির সম্পদ বেড়েছে বহু গুণ।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, রণজিত কুমার রায়ের ৪ কোটি ৫০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ টাকা দামের ১২ বিঘা কৃষিজমি, ঢাকার পূর্বাচলে ৩০ লাখ টাকা দামের রাজউকের প্লট, ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের দালান এবং ১০ লাখ টাকার অকৃষি জমি।
বর্তমানে রণজিত রায়ের নিজের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্থায়ী আমানত হিসেবে বিনিয়োগ (ডিপিএস) ১২ লাখ ৫১ হাজার টাকা, ২৩ লাখ টাকার জিপ গাড়ি, ১ লাখ টাকার ৬০ তোলা সোনা, ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাব।
২০২৪ সালের হলফনামায় রণজিত রায়ের স্ত্রী নিয়তি রানীর স্থাবর সম্পদ আছে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার তিনটি বাড়ি ও ৫০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট, যা ২০০৮ সালে ছিল না। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রণজিতের স্ত্রী নিয়তি রানীর নামে নগদ টাকা আছে ৫১ লাখ ১৫ হাজার।
২০০৮ সালে যা ছিল ৭০ হাজার। স্থায়ী আমানত হিসেবে (ডিপিএস) বিনিয়োগ আছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আরও আছে ৫৫ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া আছে ৪৫ হাজার টাকা দামের ১০ তোলা সোনা, ৪০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ১৫ হাজার টাকার আসবাব।
হলফনামায় দেওয়া সম্পদবিবরণীতে তথ্য গোপন করেছেন রণজিত কুমার রায়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তার সম্পদের চিত্র। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রণজিত কুমার রায়ের যশোর শহরের রেল রোডে একটি পাঁচতলা ও একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে।
যশোরের লোহাপট্টিতে একটি বাড়ি, যশোর নিউ মার্কেটে দুটি ফ্ল্যাট, বাঘারপাড়ায় একটি দোতলা বাড়ি, বাঘারপাড়ার খাজুরায় একটি চারতলা বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে দারুস সালাম রোডে দুটি ফ্ল্যাট, দুই ছেলের নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ও সল্টলেকে দুটি বাড়ি আছে। যশোরের চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায় ২২৫ একর জমি, খুলনার ফুলতলা উপজেলায় ৫০ একর জমির ওপর মাছের ঘের কিনেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ১ কোটি টাকা দামের একটি পাজেরো, দুই ছেলের ৬০ লাখ টাকার প্রাইভেটকার, স্ত্রীর ৩০ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেটকার ও ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। আরও কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন রণজিত রায় ও তার পরিবারের সদস্যরা।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে জেস টাওয়ার শাখার জনতা ব্যাংকের একটি লকারে রক্ষিত ২০০ ভরি স্বর্ণের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন রণজিত। ওই সময় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের মালিকানা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।