প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ছে এই রোগের প্রকোপ, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। রোগীর চাপ বাড়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি রোগীর জন্য শয্যাসংখ্যা। তার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ৯০ শয্যার আলাদা (নারী ও পুরুষ) ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। অথচ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই ভেঙে পড়েছে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের প্রায় অর্ধেকই ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দা বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রাজধানীর অধিকাংশ এডিস মশার বংশবৃদ্ধিপ্রবণ এলাকায় প্রায় দুই মাস ধরে স্প্রে (মশক নিধন ওষুধ) প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এবার অসময়েও ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কারণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস ডেঙ্গুর সিজন শেষ পর্যায় হিসেবে ধরা হয়। আর সিজন শুরু হয় এপ্রিল-মে মাসে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ব্যতিক্রম বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ৪২ দশমিক ৯৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দা আর ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে ঢাকার বাইরে। চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৩ জনের। মৃতদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ঢাকায় এবং ৩০ শতাংশ ঢাকার বাইরে। সবচেয়ে বেশি ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, এবার মশক নিধন কর্মসূচি ঠিকমতো না চলায় সিজনের শেষ দিকে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যেহেতু সিটি করপোরেশনের কাজে ব্যত্যয় ঘটেছে, সে কারণেই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এ পর্যায়ে ডেঙ্গু মশার হটস্পটগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে গত বছরের মতো পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, জিগাতলা, বাড্ডা, বাসাবো, মাদারটেক ও মিরপুরের বেশ কিছু এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। ডেঙ্গুর লার্ভা নিধনে বিশেষ কোনো অভিযানও তারা পরিচালনা করেনি বা করছে না।
মোহাম্মদপুরের মেট্টো হাউজিং এলাকার বাসিন্দা মো. আমজাদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমরা। এরই মধ্যে পরিবারের তিনজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। আগে মাসে-সপ্তাহে অন্তত এক দিন সিটি করপোরেশন থেকে মশার ওষুধ স্প্রে করে যেতেন কর্মীরা। দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ নানা কারণে প্রায় ২ মাস ধরে তাদের দেখাও মিলছে না। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন অফিসে যোগাযোগ করেও কাজ হয়নি। রাত-দিন আমাদের কাটাতে হচ্ছে মশার যন্ত্রণা সহ্য করে।’
সলিমুল্লাহ রোডের চা বিক্রেতা মো. ওহিদুর রহমান। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই মহল্লায় তার বসবাস। তিনি বললেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে আমরা টিভিতে কথা শুনি কিন্তু বাস্তবে মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রম চোখেই পড়ছে না। জনপ্রতিনিধিদের বদলে প্রশাসক দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধনে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার কোনো উপায়ই আমরা দেখছি না।’
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটিতেও প্রশাসকরা দায়িত্ব পালন করছেন। মশক নিধন কার্যক্রম কেন স্বাভাবিকভাবে চলছে না- জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধন কার্যক্রমকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। এ কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছি। তার পরও কেন তারা কাজ করছেন না তা খতিয়ে দেখা হবে। চেষ্টা আমাদের আছে, তবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সব কার্যক্রম যথাসময়ে পরিচালনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। পরিস্থিতির উত্তরণে আমরা নগরবাসীর সহযোগিতা চাই।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসাইনের মতে, দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমাতে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন করা জরুরি। সরকার যদি ডেঙ্গুর চিকিৎসাব্যবস্থা শ্রেণিকরণ করে এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ পর্যায়- এই তিন ভাগে ভাগ করে তাহলে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ও মৃত্যুহার কমানো সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি। প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন করাও জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের উচিত গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সুবিধার উন্নতি করা। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও রেলওয়ে হাসপাতালগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি। ঢাকার বাইরে মৃত্যুহার বেশির কারণ হিসেবে পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থার অভাব ও ডেঙ্গু শনাক্ত করতে না পারা বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে আরও লোকবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৬১ জন। আর আগের দিন বুধবার ৪৬৫ জন রোগী শনাক্ত হলেও কেউ মারা যাননি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত দেশে (১ জানুয়ারি থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০৩ জন। আর এ সময়ে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৪৫ জন। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১১ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৯ জন রোগী মারা যান। যাদের মধ্যে গত মঙ্গলবার এক দিনেই মারা যান পাঁচজন। মৃতের এই সংখ্যা ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।