হাসিনা সরকারের আমলে গণভবন, বঙ্গভবন থেকে শুরু করে সরকারি সব সেক্টরেই ভয়াবহভাবে বেড়েছিল দালালদের দৌরাত্ম্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও এসব দালালের কুকর্ম থেমে নেই। সুমন ইসলাম নামের এমনই একজন দালালের সন্ধান পেয়েছে খবরের কাগজ। যিনি নিজ এলাকায় মাহবুব নামে পরিচিত। সবাই জানত, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানার পিএস হিসেবে চাকরি করেন তিনি। কিন্তু আসলে তিনি তা নন। মিথ্যা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে কোটিপতি হয়েছেন এই দালাল।
একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী সুমন ইসলামের তথ্য জানতে অনুসন্ধান চালায় খবরের কাগজ টিম। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।
জানা গেছে, চাকরি দেওয়া ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন নেতাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নাম করে সুমন ইসলাম বিভিন্ন মানুষের কাছে থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারণা করেছেন নিজের ভাইয়ের ছেলের সঙ্গেও। বিভিন্ন পরিচয়ে দালালি করেন তিনি। কখনো রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর পিএস, কখনো বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ শীর্ষ পরিবহন নেতার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে, কখনো সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের শ্যালক, আবার কখনো বা বঙ্গভবনের সহকারী মার্কেটিং অফিসারের পরিচয়ও দেন তিনি। এ ছাড়া সরকারি স্টিকার ব্যবহার করে পাজেরো জিপে ঘুরে বেড়ান সুমন ইসলাম। থাকেন জিগাতলার মিতালী রোডে ২৪/ডি-এর ৮ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায়। ওই বাড়ির নিচে পার্কিংয়ে রাখা হয় পাজেরো জিপটি।
সুমনের যত সম্পদ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার ধানমন্ডিতে একাধিক ফ্ল্যাট, জিগাতলা মনেশ্বর রোডে পাবনা ড্রাই ক্লিনার্স নামের একটি লন্ড্রি দোকান ও একটি অফিস, নারায়ণগঞ্জে আব্দুল্লাহ বাহার নামে চারজনের শেয়ারে প্রায় কোটি টাকার গার্মেন্ট ব্যবসা রয়েছে সুমন ইসলামের। এ ছাড়া পাবনায় রয়েছে নিজের বাড়ি ও ফসলি জমি।
পাজেরো জিপের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটি) অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেট্রো জি এইচএ-১১-৬৩১৬ নম্বরের গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২-০২০১৩৮২। রেজিস্ট্রেশন তারিখ ৪ এপ্রিল, ২০০৫। গাড়িটির প্রথম মালিক ছিলেন রাশেদ আহম্মেদ চৌধুরী। পরে তার কাছ থেকে গাড়িটি কেনেন কাজী মারুফ আহম্মেদ। এরপর মারুফ গাড়িটি বিক্রি করে দেন জারিফ ইকবাল সিদ্দিকি নামে এক ব্যক্তির কাছে। এরপর জারিফের কাছ থেকে গাড়িটি কেনেন ফাতেমাতুজ-জোহরা নামের একজন নারী।
বর্তমানে বিআরটিতে গাড়িটি ফাতেমাতুজ-জোহরার নামে নিবন্ধিত আছে। তার বাবার নাম আবুল কালাম। নথিতে ফাতেমার গ্রামের ঠিকানা- জগৎপট্টি, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সুমনের ছবিসহ একাধিক ক্রেস্ট রয়েছে। ক্রেস্টে লেখা রয়েছে সৌজন্যে বঙ্গভবন, মো. সুমন ইসলাম, সহকারী মার্কেটিং অফিসার।
সুমন ইসলামের বাড়ির দারোয়ান আমজাদ খবরের কাগজকে বলেন, স্যার রাজনীতি করে শুনেছি। আর একটি লন্ড্রির দোকান আছে। স্যারের দুই ছেলে। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তামিম ব্যাংকে চাকরি করেন। আর ছোট ছেলে সাকিল এখনো ছাত্র। বড় ছেলে এখানে থাকেন না।
পাজেরো জিপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিপটি প্রায় ৮ মাস হলো এই গ্যারেজে রাখা হচ্ছে। সুমন পারিবারিকভাবে গাড়িটি ব্যবহার করেন বলেও জানান আমজাদ।
একটি সামান্য লন্ড্রি দোকানের মালিক কীভাবে পাজেরো জিপে চড়েন, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে কানাঘুষা। স্থানীয়রা জানান, সুমন ইসলাম একজন লন্ড্রি দোকানদার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তার পড়াশোনা। তবে তার ওঠাবসা অনেক বড়লোকের সঙ্গে। দোকানের পাশেই তার একটি অফিস আছে। সেখানেই বসে তিনি দালালির কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে টাকাও নিয়েছেন। এই টাকার জন্য প্রায়ই ওই অফিসে লোকজন আসেন ও তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান।
সুমন যে বাড়িতে থাকেন এই বাসার একজন ভাড়াটিয়া খবরের কাগজকে বলেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন সুমন। তার নিজের ভাইয়ের ছেলে সাব্বিরের কাছ থেকেও চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এই টাকার জন্য সম্প্রতি এই বাড়িতে সুমন ও সাব্বিরের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এই বিষয়ে এলাকার লোকজনও জানেন। সে মূলত একজন বাটপার। এ সময় তার শাস্তিরও দাবি জানান তিনি।
সুমনের গ্রামের বাড়ি পাবনা সদর উপজেলার ইসলামপুরে। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবার নাম সলিম উদ্দিন বিশ্বাস। তবে তাদের আগের পুরান বাড়ি পাবনা শহর থেকে বেশ ভেতরে। ইসলামপুরে তারা কয়েক বছর হলো বাড়ি করেছেন। তারা ৩ ভাই ৪ বোন। বাড়ির চারপাশে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বাড়িতে দিনের বেলায় কোনো পুরুষ থাকেন না। সুমন ইসলামের ভাইদেরও এলাকার কেউ তেমন ভালো চেনেন না। বাড়ির আশপাশের কারও সঙ্গে তাদের তেমন কথাবার্তা ও চলাফেরা নেই।
এই এলাকার চায়ের দোকানি বাবু খবরের কাগজকে বলেন, সুমন ইসলাম বলে কেউ নেই। তাকে সবাই মাহবুব বলে চেনেন। তিনি নাকি রাষ্ট্রপতির ওখানে চাকরি করেন। কয়েক মাস আগে তিনি একটি পাজেরো জিপ নিয়ে এসেছিলেন।
ওই চায়ের দোকানি আরও জানান, বাড়িতে এলে দিনের বেলায় তিনি বের হন না। কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। গ্রামের সবাই জানে এই বাড়ি রহস্যঘেরা।
সুমনের বড় ভাই খবরের কাগজকে বলেন, সুমন বছরখানেক আগে পাজেরো গাড়ি নিয়ে একবার বাড়িতে এসেছিল। কয়েক দিন থেকে চলে যায়। সুমনের আয়ের উৎস জানতে চাইলে তিনি জানান, কী করে, আমি কিছু বলতে পারব না। পরিবার নিয়ে ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকে এটুকু জানি।
চাকরির জন্য অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন কি? এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি বলতে পারব না। আমি দিনমজুর মানুষ, রাত পোহালেই পেটের চিন্তা, অন্য চিন্তা করার সময় নেই।
সুমন ইসলামের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে কথা বলে খবরের কাগজের এ প্রতিবেদক। এ সময় তিনি নিজেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও শ্রমিক দলের প্রধান সমম্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে বলে পরিচয় দেন।
পাজেরো জিপের বিষয়ে সুমন খবরের কাগজকে বলেন, গাড়িটি তিনি ৮ মাস আগে ফাতেমাতুজ জোহরার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন। তবে জোহরার ভোটার আইডি না থাকায় এখনো গাড়িটি তিনি নিজের নামে বিআরটিতে নিবন্ধন করতে পারেননি। জিপে সরকারি স্টিকার লাগানোর বিষয়ে তিনি বলেন, গাড়িতে স্টিকার লাগানো আমার ভুল হয়েছে। এখন স্টিকার খুলে ফেলেছি। তবে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
সুমন আরও জানান, নারায়ণগঞ্জে আব্দুল্লাহ বাহার নামে চার জনের শেয়ারে তার একটি গার্মেন্ট আছে। তার এসব ব্যবসা ৫০ লাখ টাকার বেশি হবে না। আগে রাজনীতি করলেও এখন ছেড়ে দিয়েছেন। এখন গার্মেন্ট ব্যবসা, লন্ড্রির দোকান ও ছেলের চাকরির আয় দিয়ে সংসার চলছে।
সুমন সম্পর্কে জানতে ফোনে কথা হয় শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, তার চাচাতো ভাই সেলিম বিশ্বাস। সুমন নামে তার কোনো ভাই নেই। তিনি বলেন, সেলিম বিশ্বাসের বাড়ি পাবনার কুঠিপাড়ায়। তিনি ২০১৭ সালে মারা গেছেন। সেলিম বিশ্বাসের দুই মেয়ে। সোহানা বিশ্বাস ব্যাংকে চাকরি করেন এবং শারমিন বিশ্বাস গৃহিণী। এ ছাড়া একপুত্র আশরাফুল বিশ্বাস পাবনা কোর্টের শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
সুমন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ছাড়া জিগাতলার ১/২ সি, মনেশ্বর রোডে পাবনা অটো ড্রাই ক্লিনার্স নামে একটি লন্ড্রির দোকান আছে তার। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তামিম ব্যাংকে চাকরি করেন। আর ছোট ছেলে সাকিল এখনো ছাত্র। সুমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। তবে খবরের কাগজের কাছে সুমন দাবি করেন, রাজধানীর জিগাতলার মিতালী রোডের একটি বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন তিনি।