তারা দুই ভাই। একজনের নাম বিপ্লব বড়ুয়া, আরেকজন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ছিলেন বিপ্লব। এখনো তিনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। আর ভুয়া চিকিৎসক বিদ্যুৎ বড়ুয়া বিপ্লবের ক্ষমতার প্রভাবে অবৈধভাবে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বিপ্লব বড়ুয়ার উন্নতিও হয় বিদ্যুৎগতিতে। এই দুই ভাইয়ের অপকর্ম নিয়ে আলোচনা শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগেও ছিল। আর এখন তারা পালিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর এই আলোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
বিপ্লব বড়ুয়ার বিরুদ্ধে এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারাই। বিপ্লব ও বিদ্যুৎ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিপদমুক্ত হয়েছেন উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পদের আগে দলের সহযোগী সংগঠনের কোনো রাজনীতি না করায় এবং সংশ্লিষ্টতায় না থাকায় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা বিপ্লবকে ‘হঠাৎ নেতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদকের পদ পেয়ে নিজের প্রভাব খাটাতে শুরু করেন তিনি। বিপ্লব বড়ুয়ার অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে লোহাগাড়া উপজেলার স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক সাধারণ সম্পাদক কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা এখন মুক্ত হয়েছি, ভালো আছি।’
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হওয়ার পর থেকে নিজেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে নিজেকে গডফাদার ভাবতে শুরু করেন বিপ্লব বড়ুয়া। সব ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন তিনি। চট্টগ্রাম ও নিজ নির্বাচনি এলাকায় আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সচিবালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়াতেন তিনি। তার এমন একাধিক বিজ্ঞপ্তি খবরের কাগজের হাতে রয়েছে। যেখানে তিনি সফর করবেন এমন স্থানে স্থানীয় ইউনিয়ন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হতো। এমন একটি বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, বিপ্লব বড়ুয়া নিজ এলাকা সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় প্রবেশের সময়সূচি, দুপুরের খাবার সময়, সভায় অংশ নেওয়ার সময় স্থানীয় ইউনিয়ন-উপজেলা চেয়ারম্যানদের যথাযথ সময় উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, চট্টগ্রামের দোহাজারী ব্রিজের পর থেকে ৪০ হাত দূরত্বে পরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিপ্লব বড়ুয়ার আগমন উপলক্ষে ‘বিপ্লব বড়ুয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ লিখে গেট ও তোরণ নির্মাণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলেও বড়ুয়ার নির্দেশে রঙিন পোশাক পরে প্রতিটি গেটে ফুল দিয়ে তাকে রিসিভ করা বাধ্যতামূলক ছিল। এসবের ব্যবস্থা করতেন বিপ্লবের কথিত পিএস আরিফ। স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়নের নেতারা তার আগমন উপলক্ষে গেট তৈরি ও রিসিভ না করলে আরিফকে দিয়ে ওই সব নেতাকে ঢাকায় এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপ্লব তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখতেন। পরে তাদের দিয়ে ফেসবুকে একাধিক প্রশংসামূলক স্ট্যাটাস দেওয়াতেন। এরপর ওই নেতারা ছাড়া পেতেন। কোনো নেতা এসবের প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিপ্লব বড়ুয়া, তার ভাই বিদ্যুৎ বড়ুয়া এবং তাদের স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। বিপ্লব ও বিদ্যুৎ সপরিবারে ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় চলে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সপরিবারে কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে তার স্ত্রী অগ্নি বড়ুয়ার বড় বোনের বাসায় আছেন। স্ত্রীর বড় বোনের কাছে দেশ থেকে শতকোটি টাকা পাচার করেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। সেখানে ওই বোনকে দিয়ে মন্ট্রিয়ল শহরে বাড়ি কিনেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া।
আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিপ্লব বড়ুয়া
গেল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করার অপরাধে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের ছয়জন নেতা-কর্মী খুন হন। বিপ্লব বড়ুয়ার যোগসাজশে সন্ত্রাসীরা এ খুনগুলো করে বলে জানান নিহতদের স্বজনরা। এমন এক নৌকার এজেন্টের বাড়িতে বিপ্লব বড়ুয়ার ক্যাডারবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে এজেন্টের এক চোখ চলে যায় এবং শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি ভেদ করে বুলেট বেরিয়ে যায়।
বিপ্লব বড়ুয়ার রোষানলে পড়ে একাধিক মামলার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৫০ জন নেতা। মিথ্যা মামলার শিকার এমন আটজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
২০২১ সালে বিপ্লব ও বিদ্যুৎ বড়ুয়াকে ইঙ্গিত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন সাবেক ছাত্রনেতা ও চট্টগ্রাম করোনা আইসোলেশন সেন্টারের প্রধান উদ্যোক্তা মোহাম্মদ সাজ্জাত হোসেন। সেই পোস্টে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন বাবলু। ১০ মিনিট পর তা মুছেও দেন। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট চলে যায় বিপ্লব ও বিদ্যুতের হাতে। ওই রাতে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। মামলাটি করেন বিপ্লব বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাতকানিয়ার সাবেক পৌর মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের। বিপ্লব ও বিদ্যুৎ চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি এবং এসপিকে ফোন করে আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতাকে রাতারাতি গ্রেপ্তার করান। তাদের যেন কোনোভাবেই জামিন না হয় বিপ্লব বড়ুয়া সে জন্য জেলা জজকে প্রভাবিত করেন। শুধু তা-ই নয়, হাইকোর্ট থেকেও যেন জামিন নিতে না পারেন, সে জন্য নানা কারসাজিও করেন বিপ্লব বড়ুয়া। একপর্যায়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হস্তক্ষেপে ফখরুদ্দিনের জামিন হলেও সাজ্জাতের জামিন দিতে বাধা দেন বিপ্লব বড়ুয়া। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে জামিন পান সাজ্জাত। এ নিয়ে দীর্ঘ লড়াই হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বিপ্লব বড়ুয়ার এমন হিংস্রতার কথা শেখ হাসিনাকেও জানিয়েছেন। এসব কথা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন মোহাম্মদ সাজ্জাত হোসেন ও ফখরুদ্দিন বাবলু।
শুধু প্রটোকল না দেওয়ার অপরাধে বিপ্লব বড়ুয়ার রোষানলে পড়ে সাত মাস জেল খাটেন সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ চৌধুরী। হত্যা মামলাসহ দুই মামলায় জেল খাটেন তিনি। আওয়ামী লীগ করা থেকে বিরত থাকতে হয় এই নেতাকে। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও শহীদুল্লাকে বসতে দেননি বিপ্লব বড়ুয়া। তার বিরুদ্ধে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর অভিযোগ দিলে তা আর পৌঁছাতে দেননি বিপ্লব। অভিযোগের কারণে আরও হিংস্র ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। শহীদুল্লাহকে এলাকায় থাকতে দেবেন না বলেও হুমকি দেন। ইউনিয়ন নির্বাচনের মনোনয়ন কেনার জন্য ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে গেলে শহীদুল্লাহকে বিপ্লব নিজের বাহিনী দিয়ে মেরে ধানমন্ডি ছাড়া করেন।
শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা হয়েও বিপ্লব বড়ুয়া ও তার ভাই বিদ্যুৎ ক্ষমতার বলে আমাদের বিরোধী দলে রেখেছেন। তোষামোদি করিনি বলে আওয়ামী লীগ করেও বিপ্লব বড়ুয়ার নির্দেশে নির্যাতন উপহার পেলাম। আমিসহ বাজালিয়ার ১৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে মিথ্যা হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তার প্রভাবে কোনো বিচারকও ন্যায়বিচার করেননি। বড়ুয়া ও তার বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর মামলা-হামলা চালিয়েছেন, তাদের নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও বসতে দেননি, সব ব্যবসা কেড়ে নিয়েছেন। সরকার পতনের পর বড়ুয়ারা পালিয়েছেন। আমরা এখন ভালো আছি।’
বিপ্লবের অবৈধ ব্যবসা ও লাগামহীন পিএস
বিপ্লবের ক্ষমতার প্রভাবে তার কথিত পিএস মো. আরিফও অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আরিফ একসময় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রোডে বাসের হেলপার ছিলেন। পরে বাসের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করতেন। ‘আরাকান সড়ক পরিবহন’ শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে বাসের হেলপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আরিফ রেজিস্ট্রেশন করেন। তার প্রমাণ খবরের কাগজের হাতে রয়েছে। বিপ্লব বড়ুয়া ও তার কথিত পিএস আরিফের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলায়। পরে আরিফ বিপ্লব বড়ুয়ার ঢাকার বাসায় কাজ করার চাকরি পান। তার চতুরতা দেখে বিপ্লব তাকে দিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-বাণিজ্য, সরকারি টেন্ডার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা কালেকশন করাতেন। এই সুযোগে স্থানীয় পর্যায়ে বিপ্লবের পিএস হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন আরিফ। সেই পরিচয় দিয়ে আরিফ ও সাতকানিয়া থানার আগের ওসি শাহজাহান মিলে কক্সবাজারে একটি ফ্ল্যাট দখল করে নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতেন। এমন একটি অভিযোগ ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে। অভিযোগের একটি কপি এ প্রতিবেদকের হাতেও এসেছে। আরিফের প্রভাব এতটাই বেশি যে একটা ছবিতে দেখা গেছে, স্থানীয় এমপি তার সামনে কুঁজো হয়ে বসে আছেন আর আরিফ পায়ের ওপরে পা দিয়ে এমপিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ ছাড়া বিপ্লবের ক্ষমতাবলে আরিফ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিপ্লবের বাসার একসময়ের কাজের ছেলেটি নিজেই ‘প্রাডো গাড়ি’তে চলতে শুরু করেন। নিজের এলাকায় চারটি প্রাডো গাড়ি নিয়ে যেতেও দেখেছেন স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বিপ্লব বড়ুয়ার যোগসাজশে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা শুরু করেন আরিফ। সাতকানিয়ার দুবাইপ্রবাসী ব্যবসায়ী ইলিয়াসের মাধ্যমে দুবাইয়ে চারটি স্বর্ণের দোকানের মালিক হয়েছেন বিপ্লব ও আরিফ। এর মাধ্যমে দেশের টাকাও বিদেশে পাচার করেছেন তারা। আরিফ প্রতি মাসে একাধিকবার দুবাই যেতেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে নিয়মিত স্বর্ণ চোরাচালান ও বিদেশি মদ আনতেন আরিফসহ আরও চারজন। একাধিকবার ধরা পড়েছেন তারা। তবে বিপ্লব বড়ুয়া নিজের ক্ষমতাবলে তাদের নিরাপদে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
২০২১ সালে গাজীপুরে বিপুল পরিমাণ সিগারেটের নকল হলোগ্রাম জব্দ করা হয়। রাইস মিলের আড়ালে চলত অবৈধ এই সিগারেট কারখানা। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন কারখানা চালাতেন বিপ্লব বড়ুয়া ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলের সরকারি কাজের টাকার পরিমাণ অনুযায়ী একটি ভাগ নিতেন বিপ্লব।
বিদেশে বাড়ি ও ব্যবসা
নিজ এলাকার স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, বিপ্লব বড়ুয়ার শ্যালক অভিজিত বড়ুয়া লন্ডনে থাকেন। শ্যালকের মাধ্যমে টাকা পাচার করে লন্ডনে বাড়ি করেছেন বিপ্লব বড়ুয়া। রাশিয়ায় গড়ে তুলেছেন ব্যবসা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন বিপ্লব। সেখানে নিজের প্রোপার্টি গড়ে তোলার কথাও শোনা গেছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ও চট্টগ্রামের খুলশী এবং কাজীর দেউড়ি এলাকায় বিপ্লবের রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি।
মনোনয়ন-বাণিজ্য ও আওয়ামীবিরোধী বাহিনী
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীর পদ পাওয়ার পর দলীয় মনোনয়ন-বাণিজ্য শুরু করেন বিপ্লব বড়ুয়া। তৃণমূল থেকে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশ করা ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করে আগে থেকে চুক্তি করা নিজের পছন্দের প্রার্থীর নাম মনোনয়ন বোর্ডে তুলে দিতেন বিপ্লব বড়ুয়া। চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নৌকার মনোনয়নের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বিপ্লব বড়ুয়া। আওয়ামী লীগের কেউ প্রতিবাদ করলে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বাহিনী দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের এলাকাছাড়া করাতেন বিপ্লব। যাদের মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লব, সেসব নেতার অনেকেই শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর ফেসবুকে লিখেছেন- তারা কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমন একাধিক পোস্টের স্ক্রিনশট এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলায় ১৭টি ইউনিয়ন ও লোহাগাড়ার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১৫ আসন গঠিত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই আসনের ২৬টি ইউনিয়নেই মনোনয়ন-বাণিজ্য করেছেন আসনের সাবেক এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী ও বিপ্লব বড়ুয়া। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার মনোনয়ন পেলেও বিপ্লব ও নদভীর পছন্দ না হওয়ায় সেই ইউনিয়নে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচিত করাতেন বিপ্লব ও নদভী। স্থানীয় প্রশাসনকে চুপ করাতে বিপ্লব বড়ুয়া সরাসরি ফোন করতেন। ওই সব ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর জন্য কেউ কাজ করলে তাকে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে এলাকাছাড়া করাতেন বিপ্লব। প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান প্রার্থী থেকে সম্পর্ক অনুযায়ী ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন নদভী ও বিপ্লব।
নৌকার মনোনয়ন পান যুবদল নেতা
জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশ করা নেতাদের নাম বাদ দিয়ে লোহাগাড়ার কালাউজান ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নৌকার মনোনয়ন ব্যবস্থা করে দেন বিপ্লব বড়ুয়া। এমন অনেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। তাদের অনেককেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে ছবি তোলার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বিপ্লব বড়ুয়া।
করোনার অনুদান লুট
দেশে করোনা মহামারিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করেন বিপ্লব ও বিদ্যুৎ বড়ুয়া। চট্টগ্রাম শহরের বাইরে ফৌজদারহাট এলাকায় ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ নামে টাকা আত্মসাতের একটি কারখানা তৈরি করেন তারা। এই হাসপাতালে করোনার চিকিৎসার জন্য বিপ্লব বড়ুয়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ফোন দিয়ে টাকা পাঠাতে বলতেন। করোনা চলাকালীন সাধারণ মানুষের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে নগদ, বিকাশ, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অন্তত ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিপ্লব বড়ুয়া ও তার ভাই বিদ্যুৎ বড়ুয়া। সরল মনে চিকিৎসা নিতে এসে হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় এক মুক্তিযোদ্ধার। এর পরই শুরু হয় সমালোচনা, বন্ধ হয় তাদের টাকা কামানোর কারখানাটি। এসব কথা ফেসবুকে লিখে গ্রেপ্তার হন সাবেক ছাত্রনেতা সাজ্জাত হোসেন।
বিপ্লবের নারী কেলেঙ্কারি
বিপ্লব বড়ুয়ার স্ত্রী সোমা বড়ুয়া বিমানবালা হওয়ায় বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে থাকতে হয় তাকে। তার স্ত্রীর এক সহকর্মীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন বিপ্লব বড়ুয়া। বিষয়টি জানাজানি হলে স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে ওই নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু বিপ্লব বড়ুয়া নারীসঙ্গ ছাড়তে পারেননি। তার পিএস আরিফের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকে নজর পড়ে বিপ্লব বড়ুয়ার। তাকে হাতছাড়া করতে চাননি এই ব্যারিস্টার। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কলেজগেটের পাশে আরিফের ফ্ল্যাটে তার স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতেন বিপ্লব বড়ুয়া। আরিফের তথাকথিত স্ত্রী হওয়ায় আরিফ কোনো বাধা তো দেননি, বরং সুযোগ করে দিতেন। এ ছাড়া গান বাংলা চ্যানেলের মালিক তাপসও বিপ্লব বড়ুয়ার জন্য হোটেল ওয়েস্টিনে নারী পাঠাতেন। তার মনোরঞ্জনের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থিত হোটেল র্যাডিসন ব্লুতেও নারী পাঠানো হতো। সাতকানিয়া নিবাসী ব্যবসায়ী কেএসআরএমের এমডি শাহরিয়ার বিপ্লবকে আর্থিক সহায়তা দিতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যার সব ব্যবস্থা করে দিতেন আরিফ। এ জন্য আরিফকে দূরে সরাতে পারেননি বিপ্লব। বরং আরিফকে অবৈধ ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
বান্ধবীকে নিয়ে ভারত পালিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যুৎ
বিপ্লবের পেশিশক্তিতে লাগামহীন ভাই বিদ্যুৎ বড়ুয়া: ২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় রাজীব নামের এক শিক্ষার্থীকে হত্যার মামলায় ১ নম্বর আসামি হন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। মামলা থেকে বাঁচতে পড়ালেখা শেষ না করেই পালিয়ে বেলজিয়াম চলে যান। ২০১৯ সালে বিপ্লব বড়ুয়া যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হন, তখন ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যুৎকে দেশে ফেরান। এরপর বিদ্যুৎ ঘাঁটি গাড়েন চট্টগ্রাম শহরে। ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক অপকর্ম করে চলেন তিনি।
চট্টগ্রাম ও নিজ এলাকা সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় সব ধরনের চাঁদাবাজির ভাগ পেতেন বিদ্যুৎ। এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভাই বিপ্লব বড়ুয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতেন বিদ্যুৎ। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে ৪৫ বছর বয়সে সরাসরি পঞ্চম গ্রেডে নিয়োগ পান বিদ্যুৎ বড়ুয়া। যদিও তার একাডেমিক সব সার্টিফিকেটই ছিল নকল। উপপরিচালক হয়েও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ‘ক্ষমতা’ যেন উপাচার্যের চেয়েও বেশি ছিল। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড থেকে আর্থিক বিষয়াদি, যানবাহন, রেস্ট হাউস ও গেস্ট হাউস সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার ও কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণও শুরু থেকেই ছিল তার হাতে। আবার টাকার বিনিময়ে নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে বিদ্যুতের বিরুদ্ধে। সরকারি কাজের টাকার পরিমাণ অনুযায়ী ২ থেকে ৩ শতাংশ টাকা বিদ্যুৎ পেতেন। এভাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অল্প সময়ে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর ভাই হওয়ায় কেউ ‘টুঁ’ শব্দ করার সাহস দেখাতেন না। কাউকে পথের কাঁটা মনে হলে দিতেন মামলা, নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে করাতেন মারধর।
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেছিলেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। কোনো কমিটির সদস্য না হওয়ার পরও প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজের সভা থেকে তিনি ভাতা নিতেন নিয়মিত। পাহাড়তলীর রোজ ভ্যালি আবাসিক এলাকায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসটিও বিদ্যুৎ বড়ুয়ার দখলে ছিল। ওই গেস্ট হাউসটির মালিক আবার উপাচার্য ইসমাইল খানের ভাই আজম খান। ভাইয়ের ফ্ল্যাট গেস্ট হাউস হিসেবে বেশি ভাড়া দিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এত কিছুর পর আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২-২৩ সালের শুদ্ধাচার পুরস্কারটিও উপপরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিজের করে নিয়েছিলেন।
ফ্ল্যাট দখল করে জলসা ঘর
বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ খুলশীতে জোর করে ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ রয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে তার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত শারমিন আক্তার নামের এক নারীকে রাখা হয়। সেটি ছিল বিদ্যুৎ বড়ুয়ার জলসা ঘর। বিদ্যুৎ ও তার ঘনিষ্ঠজনরা সেই ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন। উঠতি বয়সের মেয়েদের এনে রাতভর গান-বাজনা ও মদের পার্টি চলত সেখানে। চট্টগ্রামের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা নিয়মিত যাতায়াত করতেন সে ফ্ল্যাটে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কিছুদিন আগে স্ত্রী অগ্নি বড়ুয়া বিষয়টি জানতে পারলে বিদ্যুৎ বড়ুয়া ফ্ল্যাটটি থেকে শারমিনকে অন্যত্র সরিয়ে নেন।
বিপ্লব ও বিদ্যুৎ যেখানে গ্রুপিং সেখানে
বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সহসভাপতির পদ পেয়ে সংগঠনকে তিন ভাগ করেছেন বিপ্লব বড়ুয়া। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঢুকে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে কার্যালয়সংশ্লিষ্ট বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি তৃণমূলের রাজনীতি করে আসেননি, তাই তার কানো কর্মী বা অনুসারী নেই। অনুপ্রবেশকারীদের দিয়েই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের হেনস্তা করতেন। আর নিজের এলাকার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেল খাটাতেন। তার ভাই বিদ্যুৎ যখন পালিয়ে ইউরোপে যান, তখন তৎকালীন ইউরোপ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ গনির সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগকে তিন গ্রুপে পরিণত করেন। চট্টগ্রামেও হাইব্রিডদের দিয়ে রাজনৈতিক বলয় তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করেছেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে চলে যান এই দুই ভাই। তাদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে এবং মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।