দেশে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুও। বিগত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতি সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ২০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। আর চলতি অক্টোবরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও বাড়বে- মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশ্লেষকরা। রোগীরা ডেঙ্গুর স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা তাদের।
বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৭ জন ডেঙ্গু শনাক্ত রোগী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৭৪ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৯ জন। চলতি বছরে বিগত ৯ মাসের মধ্যে ডেঙ্গুতে সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এডিসের বিস্তার উপযোগী আবহাওয়া এখনো বিরাজ করায় এ মাসেও রয়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি।
ডেঙ্গু সংক্রমণের এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীই মানছেন না ডেঙ্গুর স্বাস্থ্যবিধি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নেই আলাদা কোনো ইউনিট। সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি বেডে রেখেই চালানো হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা। রোগীদের বিছানায় নেই মশারি। আবার কোথাও মশারি থাকলেও তা টানিয়ে ভেতরে অবস্থান করছেন না প্রায় ৫০ ভাগ রোগী। ফলে একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মাঝে ডেঙ্গু সংক্রমিত হচ্ছে।
ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় ডেঙ্গু নিয়ে গত মঙ্গলবার ভর্তি হওয়া রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী (৫৭) আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা। তার পরিবারে তিনিসহ চারজন এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
কীভাবে আক্রান্ত হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কীভাবে আক্রান্ত হয়েছি তা বুঝতে পারছি না। আমার আগে দুই ছেলে এবং বড় মেয়েও ডেঙ্গুতে ভুগেছে। তবে ছেলেদের অবস্থা বেশি জটিল না হলেও মেয়ের অবস্থা বেশ গুরুতর ছিল। এখন তারা ভালো আছে। তিন দিন জ্বরে ভোগার পর এবার আমাকেও হাসপাতালে আসতে হলো।’
হাসপাতালটির ষষ্ঠ তলায় ৩০ শয্যার একটি জেনারেল ওয়ার্ডে (পুরুষ) আলাউদ্দিনসহ তিনজন ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। অথচ তাদের কাউকেই মশারি দেওয়া হয়নি। রোগীরা নিজ ব্যবস্থাপনায় মশারি ব্যবহার করছেন না। বাংলাদেশ মেডিকেলের আরেকটি নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও রায়েরবাজারের বাসিন্দা আলমতাজ বেগমসহ (৬৫) আরও তিনজন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন সেখানেও রোগীদের নেই মশারি।
বাংলাদেশ মেডিকেলের ওয়ার্ড মাস্টার জসিম উদ্দিনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সব সময় তো আর ডেঙ্গু রোগীর চাপ থাকে না তাই আলাদা ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। সাধারণ রোগীদের সঙ্গে রেখেই তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে গেল দুই মাসে প্রতিদিনই গড়ে ১৫ থেকে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রেখে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি’। রোগীর চাপ আরও বাড়লে ভবনের সপ্তম তলায় ২৪ বেডের আলাদা ডেঙ্গু ইউনিট করার পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ডেঙ্গুর স্বাস্থ্যবিধিকে আমলে নিচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের রোগী ও তাদের স্বজনরা। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা ইউনিটে রেখে সেবা দেওয়া হচ্ছে। বেড ছাড়া ভর্তি অনেক রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক রোগীকে হাসপাতাল থেকে মশারি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মশারি ব্যবহার করছেন না। কেন মশারি ব্যবহার করছেন না জানতে চাইলে এক রোগীর স্বজন জানান, গরমে মশারির ভেতরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই মশারি না টানিয়ে ঝুঁকি নিয়েই রোগীর সঙ্গে থাকতে হচ্ছে। ওয়ার্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক জানান, আমরা বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও অনেকে মশারি ব্যবহার করছেন না।
এডিস মশা নিধনের পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নাই বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ড. মুশতাক হোসেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, সাধারণ রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের রাখলে আর সেই হাসপাতালে এডিস মশা থাকলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি আরও বাড়তে থাকবে। এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্যই ভাবা উচিত। ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের রোগীদের আলাদা রাখাই ভালো। আর সেটা করা সম্ভব না হলে মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। তবে সব রোগী মশারির ভেতরে থাকতে পারেন না, গরম সহ্য করতে পারেন না। এ কারণে আমি মনে করি সব হাসপাতালেই এডিস মশামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। আর সেই পরিবেশ রক্ষায় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ হাসপাতালে রোগীরা যান সুস্থ হওয়ার আশায়।
ড. মুশতাক আরও বলেন, প্রতিবছরই ডেঙ্গুর বিস্তার (বর্ষা মৌসুমে) আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করলেও কয়েক বছর ধরে সে ধারাবাহিকতায় আমরা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। জলবায়ুর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন সারা বছরই এডিস মশার বিস্তার উপযোগী পরিবেশ বিরাজ করায় মশা নিধনকে এখন আর মৌসুমি কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের উচিত নয় বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ। তার মতে, এডিস মশার বিস্তার সমূলে ধ্বংস করতে হলে পরিবেশ-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি মশা নিধনের সব কার্যক্রম সারা বছরই চলমান রাখা উচিত। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজের মধ্যকার যেসব সমন্বয়হীনতা তা দূর করা উচিত।