
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করবেন। পাচারকারীদের তালিকা এবং পাচার করা অর্থে ওই দেশে কেনা সম্পদের খোঁজ পেতেও আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
দুই দেশের সরকারপ্রধানদের এবারের বৈঠকে অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে অর্থ পাচারের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে। শুক্রবার (৪ অক্টোবর) মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি হবে কোনো বিদেশি সরকারপ্রধানের প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফর। সফরের সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন। বৈঠকে দুই সরকারপ্রধানের আলোচনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশে চলমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের কাঠামোর মধ্যে ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিতে মালয়েশিয়ার সমর্থন চাওয়া হবে।
মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তদন্তে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সরকারের কাছের লোক বলে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকের অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে এসেছে। তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, যে দেশগুলোতে অর্থ পাচার বেশি হয়েছে, তার মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম।
চলতি বছরের ২৯ মার্চ মালয়েশিয়ার পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতিমন্ত্রী টিয়ং কিং সিং এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএমটুএইচ) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন, যেখানে ভারতের ১ হাজার ২২৩ জন আছেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে মালয়েশিয়া সরকার নতুন করে পিভিআইপি নামে প্রিমিয়াম ভিসা চালু করেছে, যা প্রায় সেকেন্ড হোম ক্যাটাগরির। পিভিআইপি প্রোগ্রামে আবেদন করেছেন মোট ৪৭ জন বিদেশি ধনী বিনিয়োগকারী, যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। এমএমটুএইচ প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য পঞ্চাশের নিচের বয়সের ব্যক্তির জন্য প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের জন্য প্রায় ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ প্রদর্শন করতে হয়। মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) তৈরি প্রতিবেদনে হিসাব কষে বলা হয়েছে, শুধু এমএমটুএইচ কর্মসূচির মাধ্যমেই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। অথচ এসব অর্থের ৯০ শতাংশই এনবিআরের কাছে অঘোষিত। অর্থাৎ কর অনারোপিত অর্থ।
পেনাং ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে এমএমটুএইচ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ করেছিলেন বাংলাদেশিরা। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৫ শতাংশ, ২০১০ সালে ১০ শতাংশ, ২০১১ সালে ১২ শতাংশ, ২০১২ সালে ১২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৭ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছিলেন। পরের বছরগুলোতেও বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশের কারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন, তা জানতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। এনবিআর থেকেও মালয়েশিয়ার কাছে একটি তালিকা চেয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সে সময়ে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটি মালয়েশিয়া সরকারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ। বাংলাদেশ সরকার যদি প্রমাণ দিতে পারে যে কারা মানি লন্ডারিং করেছেন বা কাদের বিরুদ্ধে এ-সংক্রান্ত মামলা আছে, তাহলে তাদের তথ্য তারা (মালয়েশিয়া) দেবে। পরে বিগত সরকারের আমলে এ বিষয়ে কার্যকরী কিছু হয়নি।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে বাংলাদেশ থেকে দুইভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। প্রথমত আমদানি-রপ্তানির নামে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে হচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, সরাসরি হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব অর্থের বড় অংশই অবৈধভাবে আয় করা। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, মাদক ব্যবসাসহ অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এই অর্থ আয় হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে পুরো টাকাই অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মালয়েশিয়ার সরকারপ্রধানের সঙ্গে তার অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক। এবারে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। যদি পাচারকারীদের তালিকা পাওয়া যায় এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যায়, তবে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’
শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা
২০০৮ সালে বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, আট বছর পর তা চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে ফের ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। তিন বছর পর ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খোলে। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ১ জুন থেকে বাংলাদেশসহ বিদেশি কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। নতুন নিয়মে কর্মী পাঠাতে হলে আবারও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এবারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মালয়েশিয়ায় নতুনভাবে কর্মী পাঠানোর বিষয়টি আলোচনায় আনতে পারেন বলে জানা গেছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর
দু-দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে আসছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে শুক্রবার বিকেলে তিনি ঢাকা সফর করবেন। এদিন দুপুর ২টা বা তার পরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারেন। বিমানবন্দরে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা আছে। তাকে স্বাগত জানাতে প্রধান উপদেষ্টা যাবেন নিজেই। এরপর তিনি সরাসরি একটি হোটেলে যাবেন বলে জানা যায়। সেখানে তিনি প্রায় চার ঘণ্টা অবস্থান করবেন। প্রায় এক দশক পর মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করবেন।
মালয়েশিয়ার নেতা গত আগস্টে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানান। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে মালয়েশিয়ার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে।
মালয়েশিয়ার অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সেন্টার রয়েছে, যা সামাজিক ব্যবসার ধারণা এবং তার থ্রি-জিরো ধারণাকে প্রচার করে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি মালয়েশিয়ার কোম্পানি বাংলাদেশে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে এবং এখন শিক্ষাসহ আরও বিনিয়োগে আগ্রহী। মালয়েশিয়ার একটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাড়ি বিতরণ ও সংযোজনের জন্য চুক্তি করেছে।
গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার মন্ত্রিসভার সদস্য, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা এবং উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল থাকবে। ঢাকায় অবস্থানকালে আনোয়ার ইব্রাহিম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত এই সফরের আয়োজন করা হয়। আমরা সব বিষয়ে আলোচনা করব এবং আশা করব আসিয়ান সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২০২৫ সালে আসিয়ানের মালয়েশিয়ার সভাপতিত্ব এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোতে আরও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রত্যাশা নিয়েও আলোচনা হবে। এ সফর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অংশীদারত্ব আরও জোরদার করবে, একাধিক খাতে সহযোগিতা বাড়াবে এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।