অর্থনীতিতে এখন চলছে নানা সংকট। সবচেড়ে বড় সংকট মূল্যস্ফীতির চাপ। নতুন বাজেট নিয়ে দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। জীবনযাপনে ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তিশ্রেণি আয়করে ছাড় দেবেন তিনি। ব্যবসায়ীদের আশা ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে থাকবে প্রণোদনা। কমানো হবে করপোরেট কর। কর্মসংস্থান বাড়াতে থাকবে পদক্ষেপ। প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিতে কমবে কর। সঞ্চয়কারীদের জন্য থাকবে সুখবর। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ঘোষণা আসবে সংস্কারমূলক পদক্ষেপের।
অর্থ উপদেষ্টা সোমবার (২ জুন) যে বাজেট দিলেন তাতে নতুন অর্থবছরে এসব প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। অনেক আশার কথা শোনালেও সংকট মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই। বরং নানা ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়েছেন। কয়েক শতাধিক পণ্য আমদানিতে অগ্রিম কর বসানোর প্রস্তাব করেন। বাড়তি রাজস্ব আহরণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধির কথা বলেন। এসব কর প্রস্তাব কার্যকর হলে আরও চাপে পড়বেন জনগণ। কঠিন হবে জীবনযাপন। অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থ উপদেষ্টার প্রত্যাশা বড়। পরিকল্পনা দুর্বল। যদিও অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিএনপি বলেছে, এই বাজেটে মৌলিক জায়গায় গলদ রয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল খবরের কাগজকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, নতুন বাজেট ব্যয়ের দিক থেকে গতানুগতিক। আয়ের দিক থেকে সাহসী।
অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’। ৬৪ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্যে তিনি গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। অর্থনীতিতে ঝুঁকির কথা স্বীকার করেন। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার ওপর গুরুত্ব দেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, এই শক্তিশালী ভিত্তিই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য গতকাল বেলা ৩টায় বিটিভিতে বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। একই সঙ্গে কোথা থেকে এই ব্যয় মেটানো হবে, ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে সে কথাও তুলে ধরেন। এর আগে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অধ্যাদেশ জারি করার পর ঘোষণা করা হয় বাজেট।
যে অর্থবছরটি (২০২৪-২৫) শেষ হতে যাচ্ছে তাতে মূল বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটের আকার আগের বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম, শতকরা হারে যা ১ শতাংশ।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি।
প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। এ জন্য প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। তাই এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।’
তারুণ্যকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব’ নামে একটি নতুন উদ্যোগ চালু করা হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের যুবসমাজের শক্তি ও সম্ভাবনাকে জাতি গঠন এবং আত্মকর্মসংস্থানের দিকে পরিচালিত করার জন্য তাদের সম্পৃক্ততাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে সরকার আসন্ন অর্থবছরে দেশব্যাপী এই উৎসব আয়োজনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলেন ড. সালেহউদ্দিন। কিন্তু কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি পরিষ্কার করেননি তিনি। খাদ্যনিরাপত্তায় নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। এ জন্য সারের মজুত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। বিদেশ থেকে টাকা আনার বিষয়ে নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে দুদক কাজ করছে। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রচলিত আইনের পুনর্গঠন ও সংশোধনের প্রস্তাব করেন।
সামাজিক সুরক্ষায় নজর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বয়স্ক, বিধবাসহ ভাতাভোগীদের মাসিক টাকার অঙ্ক ও আওতা বাড়িয়েছেন তিনি। দুস্থদের সহায়তায় চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সম্পদের সুষম বণ্টন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে।
কর প্রস্তাব
কর আহরণ বাড়াতে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদে কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে করারোপ ও করছাড় দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আহরণের কথা বলেন। আয় থাকুক আর না থাকুক, নতুন করদাতাদের জন্য ১ হাজার টাকা ধার্য করেন তিনি। কৃষিতে নজর দেন। এ খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বছরে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার ঘোষণা দেন। সর্বজনীন পেনশন থেকে উদ্ভূত আয়ে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ১২টি সেবা নিতে শুধু টিআইএন জমা দিলে হবে- নতুন বাজেটে এমন বিধান করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবায় উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এই সেবা আরও সহজ হবে।
যারা বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানি করেন, নতুন বাজেটে তাদের কর বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণসেবার বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে এ খাতের খরচ বাড়বে। অনলাইন ব্যবসায় কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর ফলে এই খাতের খরচ বাড়বে। এসব কর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাড়তি ১৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেটের আকার
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা দেন। এটি জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি বা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে।
অর্থায়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক- এ দুই উৎস থেকে ঘাটতি পূরণ করা হবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি
আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ।