রাজধানীর মোহাম্মদপুর এখন আলোচিত একটি এলাকা। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে এই এলাকা অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনটি সেনাক্যাম্প স্থাপন ছাড়াও সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গতকাল সোমবার (২৮ অক্টোবর) সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে ৪টি হটস্পটকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, চোর-ডাকাতসহ সব ধরনের অপরাধীরা। এই চারটি হটস্পট হচ্ছে- বছিলা বেড়িবাঁধ, ঢাকা উদ্যান, জেনেভা ক্যাম্প ও টাউনহল বিপরীত পাশের জেনেভা ক্যাম্প।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খবরের কাগজকে জানায়, সরকার পতনের পর মাদক কারবারিরা নতুন কৌশল নিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের ৪টি হটস্পটে মূল সড়ক ও অলিগলিতে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে শিশু কোলে নিয়ে নারী মাদক কারবারিরা বসে থাকেন। এই নারীদের কাছে থাকে গাজা, হেরোইন ও ইয়াবা। সুযোগ বুঝে তারা তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। সম্প্রতি বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও জানায়, এলাকার গডফাদাররা এখন পলাতক রয়েছেন। যারা এখন এই এলাকায় অপরাধ করছেন তারা দিনের বেলায় তুরাগ নদীর ওপারে ধানখেতে ঘুমিয়ে থাকেন। তারা ভোর ৫ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘুমান। সন্ধ্যার পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় তারা ঢুকতে থাকেন ও সব ধরনের অপরাধ কার্যক্রম চালান।
মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর থানার এলাকাগুলোতে তিনটি স্থানে সেনাক্যাম্প বসানো হয়েছে। ঢাকা উদ্যানে একটি, বছিলা বেড়িবাঁধে একটি ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি সেনাক্যাম্প বসানো হয়েছে। এর মধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সেনাক্যাম্পটি হচ্ছে প্রধান ক্যাম্প। অন্য দুটি হচ্ছে শাখা ক্যাম্প।
এর মধ্যে ঢাকা উদ্যানের ৩ নম্বর রোডের সেনাক্যাম্পটি ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, নবীন হাউজিং ও চন্দ্রিমা উদ্যানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। মোহাম্মদীয়া হাউজিং, মোহাম্মদীয়া লিমিটেড ও নবোদয় হাউজিংয়ে অপরাধ দমনে কাজ করছে বছিলা সেনাক্যাম্প। এ ছাড়া আদাবর, কৃষি মার্কেট, জেনেভা ক্যাম্প ও টাউন হলের বিপরীত পাশের জেনেভা ক্যাম্প দেখভাল করা হচ্ছে শেরেবাংলা নগর ক্যাম্প থেকে।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছিল তাদের। তবে গত রবিবার থেকে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করায় ও সেনাক্যাম্প হওয়ায় বর্তমানে অনেকটা স্বস্তিবোধ করছেন তারা।
মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৩ নম্বর রোডের বাসিন্দা আলতাফ মাহমুদ খবরের কাগজকে জানান, ‘কিছুদিন আগে এই রোডে ১১ লাখ টাকা ছিনতাই ও বছিলায় ডাকাতির ঘটনার পর ভয়ে দিন কাটছিল। এখন সেনাক্যাম্প হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছি ও আশার আলো দেখছি।’
ঢাকা উদ্যানের ৩ নম্বর রোডের মায়ের দোয়া দর্জির দোকানের কর্মচারী রিপন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখানে ব্যবসা করা কঠিন। যেকোনো সময় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে।’
তাহলে ব্যবসা কীভাবে করেন, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঝামেলা হলে দোকান বন্ধ করে দিই।’
এখানে সেনাক্যাম্প হয়েছে, সেনাবাহিনী আসার পর অপরাধ কমেছে কি? উত্তরে রিপন জানান, সেনাবাহিনী এসেছে দুই দিন হলো। এখন ভয় কম লাগছে।
এ ছাড়া মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের মূল সড়কের পাশে অস্থায়ীভাবে প্রতি দিনই বসে প্রায় ৪০টি ফলের দোকান। এখনে ফলের ব্যবসা করা ফরহাদ জানান, এখন চুরি-ছিনতাই হলেও চাঁদা দিতে হয় না। আগে দিনে ২৫০ টাকা করে এলাকার কমিশনারের লোকদের চাঁদা দিতে হতো। তাই ব্যবসার লাভের পুরো টাকা ঘরে নিতে পারেন না।
তিনি জানান, প্রতিদিনই সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের টহল গাড়ি দেখা যায়। তারা নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাই দিনের বেলায় খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তবে রাতে চুরি-ছিনতাই থেমে নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান গতকাল সোমবার দুপুরে মোহাম্মদপুর থানায় আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি জানান, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ফেরাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব একসঙ্গে কাজ করছে। মোহাম্মদপুর এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল বাড়িয়েছে, চেকপোস্ট বসিয়েছে, ব্লক রেড করছে ও বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে।
মোহাম্মদপুরে অস্ত্রের ছড়াছড়ি
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, সরকার পতনের আন্দোলন দমন করার জন্য এই এলাকায় শত শত অস্ত্র সন্ত্রাসীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যার বেশির ভাগই এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেই অস্ত্রগুলো দিয়ে এখন অপরাধীরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গত রবিবার শেরশাহ সুরি রোড থেকে চাপাতিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সামনে থেকে ডাকাতদলের ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ছাড়া গত ১৬ অক্টোবর জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে শাহনেওয়াজ কালু (৩৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন জেনেভা ক্যাম্পের বাবুল হোসেনের ছেলে অটোরিকশাচালক সানু।
গত রবিবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৩ নম্বর রোডে প্রকাশ্যে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকিয়ে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
সম্প্রতি মোহাম্মপুর তিন রাস্তার মোড়ে (বছিলা বেড়িবাঁধসংলগ্ন) হাজী ভিলায় মধ্যরাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ডাকাতদল একটি বাসায় ঢুকে ‘নগদ ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার’ লুট করে।
এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনখারাবি বেড়ে যাওয়ায় এলাকাবাসী গত শনিবার বিকেলে মোহাম্মদপুর থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। এমন অবস্থার জন্য তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য তারা পুলিশকে তিন দিনের সময় বেঁধে দেন। এরপর গত শনিবার রাতেই যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।