‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা-
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের কলি দুটির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় দেশের আদালত অঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে। গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামীপন্থি পদস্থ আইনজীবীদের চেম্বারে ছিল ভিড়। বিশেষ করে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন মামলার আসামির স্বজনরা জামিনের জন্য আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের চেম্বারে ভিড় জমাতেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আন্দোলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনায় করা মামলার আসামি এখন আওয়ামীপন্থিরাই। বিশেষ করে আওয়ামীপন্থি আইনজীবী নেতাদের অনেকে এখন হত্যা মামলার আসামি। ফলে তাদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে।
যেমন অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু। আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। ঢাকা বারের সবচেয়ে ব্যস্ত আইনজীবীদের একজন ছিলেন তিনি। গত রবিবার ভরদুপুরেও দেখা গেল তার চেম্বারে তালা ঝুলছে। বাইরে নেমপ্লেটের স্ক্রুগুলো আছে, তবে নেমপ্লেটের চিহ্ন নেই। ধুলার স্তর পড়েছে তার চেম্বারের বন্ধ দরজায়।
তার মতো আওয়ামীপন্থি আআইনজীবীদের সবার চেম্বারেই যে তালা ঝুলছে- এমন নয়। কারণ আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পাওয়া আইনজীবীরা আত্মগোপনে বা নাজেহাল হওয়ার ভয়ে আদালতে না এলেও তাদের চেম্বারের অন্য আইনজীবীরা তো নিজেদের মামলা নিয়ে আদালতে আসছেনই।
তবে আওয়ামী লীগের নামকরা আইনজীবীদের মক্কেলরা আছেন বিপাকে। কারণ তাদের অনেককেই আইনজীবী বদলাতে হচ্ছে। এর বড় একটি কারণ হচ্ছে অনেক মক্কেলেরই বিশ্বাস ক্ষমতাসীন দলের আইনজীবী নেতাকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিলে মামলায় জেতা সহজ হয়। সেই একই বিশ্বাসে এখন তারা আওয়ামীবিরোধী বলে পরিচিত আইনজীবীদের কাছে মামলা নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এখন মামলা পাচ্ছেন বেশি। ব্যস্ততা বাড়ছে তাদের।
এমন প্রবণতার ব্যাপকতার উদাহরণ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত আইনজীবী কুমার দেবুল দে গত রবিবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার অতিসাধারণ একটি মামলা বিএনপিপন্থি আইনজীবীর কাছে নিয়ে গেছেন মক্কেল। তিনি বলেন, চেক ডিজঅনারের একটি সাধারণ মামলা, মক্কেল আমাকে জানিয়ে যাবেন, সেই সৌজন্যতাটুকু পর্যন্ত দেখাননি। আদালতে মক্কেলের সঙ্গে আমার এক দিন দেখা হয়ে গেছে, তখন তিনি জানান যে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপিপন্থি একজন আইনজীবীর কাছে মামলাটি নিয়ে গেছেন।’
আদালত অঙ্গনে এমন উদাহরণ ভূরিভূরি থাকলেও আওয়ামীপন্থি কোনো আইনজীবী নাম প্রকাশ করতে চান না। কারণ তারা মনে করেন, নাম প্রকাশ হলে অন্য মক্কেলদের মধ্যেও মামলা আওয়ামীবিরোধী আইনজীবীদের কাছে নিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা বাড়তে পারে।
আর বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অনেকে মনে করেন ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে মামলা বাড়ছে- কথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়াটা অশোভন হয়।
আদালতে পরিবর্তনের এই চিত্র এবং শোভন-অশোভনের বিষয়টি উঠে আসে আইনজীবী কুমার দেবুল দের সাম্প্রতিক এক ফেসবুক পোস্টেও।
এতে তিনি লিখেছেন, ‘কথায় আছে কোনো আইনজীবীর প্রয়োজনীয়তা মক্কেলদের কাছে বা সহ-আইনজীবীদের কাছে (সিনিয়র ব্রিফের ক্ষেত্রে) যদি সিজনাল হয় বা ক্ষমতার অথবা রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে বাড়ে বা কমে তাহলে তিনি সে অর্থে গ্রামাটিক্যাল আইনজীবী নন যদিও তিনিও অনেক বড় আইনজীবী। তিনি সেই রকম একাডেমিক আইনজীবী নন কারণ উনার পিক সিজনে তিনি অনেক ব্যস্ত থাকেন কারণ টাইম ইজ মানি, একজন আইনজীবী যদি সত্যিকারের একাডেমিক আইনজীবী বা গ্রামাটিক্যালি আইনজীবী হয়ে থাকেন তবে তিনি কখনই সিজনাল হন না, ক্ষমতার পালাবদল বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও উনার প্রয়োজনীয়তা এক চুল পরিমাণও কমবে না। তবে একজন আইনজীবীর ব্যস্ততা নির্ভর করে তার ওকালতির দক্ষতার ওপরে।
যে আইনজীবী একটা মামলা শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঝখানে যতগুলো ধাপ আছে সেগুলো সুচারু এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তখন তার পরিচিতি এবং ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পায় মক্কেলদের কাছে এবং স্বয়ং বিচারকের কাছেও। একজন আইনজীবীর সবচেয়ে বড় বিচারক হলো তার শুনানির সময় তার পিছনে আদালত কক্ষে বসে থাকা সহ-আইনজীবীরা। যেদিন একজন আইনজীবীর প্রশংসা তার সহ-আইনজীবীদের মুখে শোনা যাবে সেই দিন একজন আইনজীবীর সফলতার ষোলকলা পূর্ণ হয়, কারণ বাঙালি আর যাই হোক সহকর্মীর প্রশংসা করতে খুবই কম ইচ্ছুক।’
তবে আওয়ামীপন্থি নামকরা আইনজীবীদের অনেক জুনিয়র বা সহ-আইনজীবীরা মামলা ধরে রাখতে কৌশলী অবস্থান নিচ্ছেন। তারা মামলা নিয়ে আদালতে যাওয়ার সময় এখন বিএনপিপন্থি নামকরা আইনজীবীদের কাউকে নিয়ে যাচ্ছেন।
যদিও তাতে বিচারপ্রার্থীদের মামলার খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়ার পর এমন হয়ে আসছে। এতে করে শুধু বিচারপ্রার্থীর খরচ বাড়ছে তা নয়, রাজনৈতিক পরিচয় এড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে চলতে চাওয়া আইনজীবীদের জন্যও বিব্রতকর। আবার জুনিয়র আইনজীবীরাও পড়াশোনা করে ভালো আইনজীবী হওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়াকে সহজ পথ ভাবেন। কারণ যুগের পর যুগ তাদের সামনে এটিই উদাহরণ।
তাদের পরামর্শ এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিচারকদের পড়াশোনা করা আইনজীবীদের প্রাধান্য দিতে হবে। আইনজীবী সিনিয়র-জুনিয়র যাই হোন, রাজনৈতিক পদ-পদবি থাকুক বা না থাকুক, সংশ্লিষ্ট মামলায় তার উপস্থাপন করা যুক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
একইভাবে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপরও জোর দেন তারা।