অর্থবিত্তের মালিক, একান্ত অনুগত এবং বয়সে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলের চেয়ে কম হতে হবে। এটাই ছিল মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে বিভিন্ন পদ পাওয়ার অন্যতম মাপকাঠি। একই যোগ্যতা ছিল উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রেও। এ কারণে অনেক ত্যাগী ও দুঃসময়ের নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলটির আত্মগোপনে থাকা নেতা-কর্মীদের এমন কিছু অভিযোগ আলোচিত হচ্ছে। ৭ আগস্ট মিরসরাই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রুহেল তার ফেসবুক ওয়ালে একজন সেনা অফিসারের (মিরসরাই ক্যাম্পে দায়িত্বরত) মোবাইল নম্বর পোস্ট করেন। দেখা গেছে, ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে তার দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ-ভর্ৎসনায় ভরে গেছে। পোস্টটির ৭৮৯টি কমেন্টের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ কমেন্ট নেতিবাচক। এ ছাড়া কিছু কিছু কমেন্টে মিলেছে দলের অভ্যন্তরে বাবা-ছেলের ১৫ বছরের অপকর্মের ফিরিস্তি, যা মোশাররফ ভক্তদের জন্য খানিকটা বিব্রতকরও ছিল।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগ ও মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে মিরসরাই আসনে নির্বাচনের সুযোগ পেয়ে নেতা বনে যান মোশাররফ হোসেন। সুযোগ পেয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি দলটির দুঃসময়ের নেতা হটানোর অভিযানে লিপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাজপথে নামেননি তিনি। যে কারণে গ্রেপ্তারও হননি। বরং তিনি ওই সময় নিজের বাবার ব্যবসাপাতি দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে করে গেছেন। পরে তিনি নিজেকে চট্টগ্রাম উত্তরের অভিভাবক হিসেবে দাবি করতে শুরু করেন।
নেতা-কর্মীরা জানান, একসময় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মোশাররফ হোসেন। সেই সুবাদে তিনি উত্তর চট্টলার রাউজান-রাঙ্গুনিয়া ছাড়া বাকি সব উপজেলার রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতেন। গ্রুপিং করে দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছেন। পরে তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য হলে সেই বলয় আরও বেশি শক্তিশালী হয়। মূলত, বিত্তশালী লোকদেরই তিনি তার বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। যে কারণে ত্যাগী এবং বঙ্গবন্ধুর আমলের আওয়ামী পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে একপর্যায়ে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়।
নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোশাররফ। তিনি পরে নিজের স্থলে তার মেজো ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলের সিংহাসন পাকাপোক্ত করতে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের অনুগতদের গণহারে স্থলাভিষিক্ত করতে শুরু করেন। এ সময় একে একে বিতাড়িত হন মিরসরাই আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাহসী ও জনপ্রিয় নেতা এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন, সত্তরের দশকের চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ নেতা ও পরবর্তী সময়ে একাধিকবার মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা নুরুল হুদা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু, মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক মহিউদ্দিন আহম্মেদ রাশেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম খোরশেদ আলম, মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মকছুদ আহম্মদ চৌধুরীসহ অসংখ্য নেতা।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ও মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা নিয়াজ মোর্শেদ এলিট খবরের কাগজকে বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি একটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। মোশাররফ পরিবারের একান্ত আস্থাভাজন হলে অন্য দলের কিংবা রাজনীতি না করা ব্যক্তিও বড় পদ পেয়ে যান। এমনকি চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হয়ে যান। এই পরিবারের একান্ত অনুগত না হওয়ার কারণে তিনিসহ অনেক ত্যাগী নেতা মিরসরাইয়ে রাজনীতি করতে পারেননি। তাদের কৌশলে কোণঠাসা করে রাজনীতির মাঠ থেকে বের করে দিয়েছেন। এভাবেই একটি পরিবারের হাতে ধ্বংস হয়েছে আওয়ামী লীগ।
দলের একাধিক নেতা জানান, একটা সময় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাকে চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির ‘অভিভাবক’ এবং ‘বড় হুজুর’ নামে সম্বোধনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এই বড় হুজুরের দোয়া পেলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের প্রয়াত বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘এস রহমান ট্রাস্টে’ যে নেতা যত বেশি টাকা ঢালতে পারতেন তাকে তত বেশি বড় পদে আসীন করা হতো। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি।’ তার বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
মিরসরাইয়ের একাধিক নেতা খবরের কাগজকে জানান, নিজের আসন মিরসরাইয়ে পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নির্বাচন না করে ছেলে রুহেলকে মনোনয়ন নিয়ে দেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন। তাকে জোর করে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গিয়াসকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনের পর তিনি নিজ এলাকায় গেলে গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। তার অনুসারীদের মারধর করে মামলা দেওয়া হয়।
একইভাবে এলাকা থেকে অনেকটা বিতাড়িত করার চেষ্টা হয়েছে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিটকে। তার গাড়িবহরে গুলির ঘটনাও ঘটেছে। যুবলীগ নেতা হয়েও তিনি আওয়ামী লীগের আমলে নিজ এলাকায় সভা-সমাবেশে করতে পারেননি। সর্বশেষ বলি হয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান।
ছেলেকে যেন কেউ তুমি করে বলতে না পারে
গত দেড় দশক ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দেন মোশাররফ। পাঁচ বছর ধরে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নাক গলাতে শুরু করেন রুহেল। আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের উপজেলা এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিতে নিজের ছেলের চেয়ে কম বয়সীদের প্রাধান্য দিতেন। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোশাররফ পরিবার সমর্থন দেন এনায়েত হোসেন নয়নকে। এতে জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান কোণঠাসা হয়ে নির্বাচনে হেরে যান। একইভাবে মিরসরাই পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন ও বারৈয়ারহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম খোকন দুজনই বয়সে রুহেলের চেয়ে ছোট। খোকনের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং লালন-পালনের অভিযোগও রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সহকারী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এরাদুল হক নিজামী ভুট্টু বয়সে রুহেলের ছোট এবং অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক। মোশাররফের নির্বাচনে তিনি লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রুহেলের প্রচারে বেশির ভাগ খরচ তিনিই করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মাস্টার ও ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেনও বয়সে ছোট। এভাবে যখনই সুযোগ এসেছে নিজের অনুগত এবং কম বয়সী অর্থ-বিত্তওয়ালাদের চেয়ারে বসিয়েছেন মোশাররফ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মিরসরাই উপজেলার জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে কথা বলব না। তবে একটা কথা বলতে চাই। আমাদের সমাজে একক আধিপত্যবাদ মহামারি আকার ধারণ করেছে। সেটা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে। কোনো আসন থেকে কেউ একবার এমপি নির্বাচিত হতে পারলে আজীবন তিনিই এমপি হবেন। তিনি বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেলে কিংবা মৃত্যু ঘটলে তার ছেলে অথবা মেয়ে নির্বাচিত হবেন। তার যোগ্যতা শুধু তিনি ওই নেতার সন্তান। এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। দলের বাকিদের জন্মই হয়েছে যেন তাদের বারবার চেয়ারে বসানোর জন্য। প্রকৃতপক্ষে কোনো নেতার সন্তান হওয়া যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। এই অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। তবে কোনো নেতার সন্তান যদি তার যোগ্যতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারেন হোক। তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।’