করযোগ্য আয় থাকার পরও রিটার্ন জমা না দিলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রিটার্নে সম্পদ-আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিলেও একই শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি হিসেবে জরিমানার পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রয়োজনে হিসাব জব্দ এবং রাজস্ব আইনে মামলা করতে পারবে। মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য এবার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবে এনবিআর।
এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, করযোগ্য হওয়ার পরও কেউ রিটার্ন জমা না দিলে তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে নির্ধারিত কর অঞ্চল থেকে নোটিশ পাঠানো হবে। রাজস্ব আইনে মামলা করার আগে রিটার্ন জমা না দেওয়ার বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়ার বিস্তারিত কারণ জানতে প্রয়োজনে এনবিআরে ওই করদাতাকে তলব করা হবে। রিটার্ন জমা না দেওয়ায় জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে হিসাব জব্দের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে পারবে এনবিআর। এ ছাড়া নিয়মিত সময়ের পর রিটার্ন জমা না দিলে রেয়াতের সুবিধা দেওয়া হবে না। করযোগ্য হওয়ার পরও ইটিআইএন গ্রহণ এবং সঠিক হিসাব দিয়ে রিটার্ন জমা দিয়েছে কি না, তা যাচাই করতে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হবে স্বেচ্ছাসেবক (ভলান্টিয়ার)।
স্বেচ্ছাসেবকরা রাজধানীসহ সব বিভাগ, জেলা, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দেবেন। জনপ্রতি সেবাদানের ভিত্তিতে তাদের কমিশন দেওয়া হবে। সংগৃহীত তথ্য স্বেচ্ছাসেবকরা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে জানাবেন।
এনবিআর সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ আবু দাউদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা দেশের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি এবারই এসব নিয়োগ শেষ করার। কতটা পারব এখনই বলতে পারছি না। স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে করদাতাদের রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দেবেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের কাজে আগের চেয়ে গতিশীলতা বাড়ানো হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা সারা বছরই করদাতাদের সেবা দিয়ে চলছেন। এনবিআর কর্মকর্তারা সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে কেউ যদি করদাতাদের হয়রানি করে, অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে বা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে, তবে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
সম্প্রতি এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা গড়ে ৬ শতাংশ। গত পাঁচ করবর্ষের ইটিআইএনধারী এবং রিটার্ন জমার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইটিআইএনধারীর ৬০ শতাংশই রিটার্ন জমা দেন না। যারা রিটার্ন জমা দেন তাদের অর্ধেকের বেশি সম্পদ-আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। অথচ রিটার্নধারীর সংখ্যা গড়ে পাঁচ কোটি হওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এখনো এনবিআর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবে অতীতের এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কৌশলে কাজ করে করদাতা, করের পরিমাণ এবং রিটার্ন জমার পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এবার প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে।’
এরই মধ্যে চার সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলের অধিভুক্ত সরকারি কর্মচারী, সারা দেশের তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ), নেস্লে বাংলাদেশের কর্মীসহ কয়েকটি খাতের পেশাজীবীদের অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সঠিক হিসাবে রিটার্ন জমা দিতে এবং অনলাইনে রিটার্ন জমায় উৎসাহিত করতে এরই মধ্যে খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবার নতুন কৌশলে করদাতা এবং রিটার্নধারীর সংখ্যা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে টিআইএন গ্রহণ ও রিটার্ন জমায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে কর পরিশোধে স্বচ্ছতা আসবে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, এবার এনবিআর কর্মকর্তাবহির্ভূত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব স্বেচ্ছাসেবক কতসংখ্যক মানুষকে রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছেন তার ওপর হিসাব কষে নির্ধারিত হারে ফি দেওয়া হতে পারে। এ কাজে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো হতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবকরা শুধু যে এসব তথ্য যাচাই করবেন তা না, তারা রাজস্বসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করবেন। অনলাইনে ইটিআইএন প্রদান, রিটার্ন ফরম পূরণ এবং অনআইনে করের পরিমাণ হিসাব কষে বের করতেও সহায়তা করবেন। ঘরে বসেই কীভাবে কর পরিশোধ করা যাবে তার সহায়তাও করবেন।
এনবিআর সংস্কারসংক্রান্ত কমিটির সদস্য এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণত বড় মাপের করদাতারা কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। এসব ব্যক্তি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার রিটার্নই জমা দেন না। রিটার্ন জমায় কঠোরতা আনা সম্ভব হলে দেশের করের পরিমাণ বাড়বে।’
আয়কর আইন অনুযায়ী, করদাতা ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন দাখিল করবেন। এই সময়ের পর রিটার্ন জমা দিলে আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৭৪ অনুযায়ী ওই করদাতার যেকোনো ধরনের কর অব্যাহতি বা করমুক্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কোনো ধরনের বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। এভাবে হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাবেন না। শুধু তা-ই না, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৬৬ অনুযায়ী তাকে নির্ধারিত হারে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। এই জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা। প্রয়োজনে প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা করে জরিমানা করা যাবে। রিটার্ন জমা দিচ্ছেন কিন্তু আরোপযোগ্য কর হয়নি, এমন করদাতাদের সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
এনবিআর বিশেষ কারণ দেখিয়ে নিয়মিত কর প্রদানের সময় বাড়াতে পারবে। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে অনেকে রিটার্ন জমার প্রস্তুতি নিতে পারেননি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা গেছে তাই কর জোগাড় করা সম্ভব হয়নি- এমন কারণ দেখিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে এনবিআর রিটার্ন জমার নিয়মিত সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।
৩০ নভেম্বরের পর রিটার্ন জমা দিলে জরিমানা যেমন দিতে হবে, তেমনই কোনো কর রেয়াতও মিলবে না। যেমন এতদিন যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, ইন্টারনেট বিলসহ নানা ধরনের ভাতা পান চাকরিজীবীরা। এসব ভাতার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। এসব ভাতার অর্থ আর করমুক্ত থাকবে না।
আয়কর আইনে একজন ব্যক্তির প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য কর। পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এর পরের ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর ১০ শতাংশ। পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর ১৫ শতাংশ। এর পরের ৫ লাখ পর্যন্ত কর দিতে হবে ২০ শতাংশ হারে। অবশিষ্ট যা মোট আয় থাকবে সেটির ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। নারী এবং ৬৫ বছর বা তারচেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত ব্যক্তি আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা।
আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে একজন করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় এবং সম্পদের তথ্যাবলি নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করার মাধ্যম হচ্ছে রিটার্ন।