ইসলামবাগ ঈদগাহ মাঠ। এর উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে বামে একটি সড়ক। সেই সড়কে ঢুকে একটু সামনে এগোলে আবার বামে ঢুকেছে খুব সরু গলি। গলির মুখ থেকে সামান্য হাঁটলেই বামের বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে কানে আসে মেশিনের ঘস ঘস শব্দ। মেইন গেট লাগানো। সামান্য একটু জানালা খোলা। ভেতরে তাকাতেই দেখা যায়, মেশিন থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে পলিব্যাগ। কারখানাটি বেশ বড়ই।
আরেকটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে আরেকটি কারখানা। একটিই গেট। গেটটি খোলা। সামনে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। গেট বরাবর। ভেতরে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন কমবয়সী একটি ছেলে। মেশিন থেকে তার সামনে এসে পড়ছে পলিব্যাগ। একটু বেশি হলে তিনি সেগুলো নিয়ে গেটের বাম পাশে বসানো আরেক ছোট মেশিনে রেখে একটা অংশ কেটে পলিব্যাগের হাতল বা হ্যান্ডেল বের করছেন। ভেতরে আছেন আরেক যুবক। পলি তৈরির কাঁচামাল অর্থাৎ দানাগুলো তিনিই মেশিনে দিচ্ছেন। তারপর সেগুলো পলিব্যাগ হয়ে বেরিয়ে আসছে।
মেশিনে দানা দেওয়ার পর পিছে ফিরে এ প্রতিবেদককে দেখে তিনি কাছে এসে বলেন, ভেতরে আসা নিষেধ। আপনি কিছু বলতে চাইলে বাইরে একটু অপেক্ষা করেন। আরেকটু কাজ করে আসি। এ প্রতিবেদক বাইরে গেলে তিনি গেটটি লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর বাইরে আসেন ওই যুবক।
বুধবার বেলা ১২টার দিকে সরু গুলির এক খাম্বার পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় ওই যুবকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক জানান, তিনি এখানে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়েই তার সংসার চলে। শুনেছেন সরকার পলি নিষিদ্ধ করেছে। তাতে যদি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তার পেশা বদল করতে হবে। কোন পেশায় যাবেন, তা তিনি এখনো ঠিক করেননি। শুধু তিনিই নন, আরও বহু মানুষকে পেশা বদলাতে হবে। তার বক্তব্য পলি তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তার মালিকের অটোরিকশা চালানো ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
কারখানার মালিকের নম্বর চাইলে তিনি জানান, মোবাইল নম্বর দিতে নিষেধ আছে। মালিক সন্ধ্যায় আসবেন। দিনে থাকেন না। কাউকে ভেতরে ঢুকতে না দিতেও মালিকের নিষেধ আছে। দিন-রাত মিলিয়ে তারা চারজন কর্মচারী কাজ করেন। ২৪ ঘণ্টাই এই কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হয়। ৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ১২ ইঞ্চি সাইজের সাদা টানা ওয়ালা পলিব্যাগ উৎপাদন করা হয়।
আজ ১ নভেম্বর থেকে দেশে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ইসলামবাদ, চকবাজার, লালবাগ, দেবিদাসঘাট লেন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পলিথিন সংশ্লিষ্ট সব কারখানায় ব্যস্ত সময় কাটছে কারখানার শ্রমিকদের, উৎপাদন হচ্ছে আগের মতোই। সরকারের ঘোষণায় কোনো প্রভাব পড়েনি। তারা বলছেন, সরকার চাইলেই হুট করে বন্ধ করে দিতে পারে না। কারণ এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা না করে সরকার এটা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট সবাই রাস্তায় নেমে আসবেন। এই সেক্টরের পরিসর অনেক বড়। সরকারকে সবার বিষয়েই ভাবতে হবে। পরিবেশ রক্ষার কথা বলে এত মানুষের জীবন-জীবিকা তো ঝুঁকিতে ফেলতে পারে না।
দেবিদাসঘাট লেন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কারখানার সামনে ইজিবাইকে পলিব্যাগভর্তি কয়েকটি বস্তা এনে রাখছেন এক শ্রমিক। কিসের পলি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো অর্ডারের। আপনার কোন ধরনের ব্যাগ লাগবে? একেক কারখানায় একের ধরনের পলি। আপনার কোন ধরনের লাগবে? আর সব জায়গায় আপনি পলি পাবেন না। কোনো কারখানায় রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। আবার কোনো কারখানা সেই দানা থেকে চাহিদামতো পলিব্যাগ বানায়। একেক কারখানা একেক রকম পলি বানায়।
একটু সামনে চায়ের দোকান। পাশেই রয়েছে একটি রিসাইক্লিং কারখানা। চায়ের দোকানে বসে কথা হয় একটি রিসাইক্লিং কারখানার মালিক মো. সেন্টুর সঙ্গে। তিনি ২২ বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছেন। তিনি জানান, এই ব্যবসার টাকায় তিন ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন। অথচ নিজে নামও লিখতে পারেন না। প্রথমে তিনি একটি কারখানায় কাজ করতেন। কাজ শিখে নিজে কারখানা করেন।
মো. সেন্টু বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা দানা থেকে পলি বানানোর সময় যেগুলো নষ্ট হয় সেগুলো বিভিন্ন কারখানায় আবার রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। টোকাই বা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মানুষের ব্যবহৃত পলি যেগুলো কুড়িয়ে বিক্রি করেন ওগুলোও রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। যদি পলি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হবেন। তাই সরকারকে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। যেমন এমন কোনো মেডিসিন তৈরি করা যায়, যা পলি বানানোর সময় দিয়ে দিলে নির্দিষ্ট সময় পর তা মাটিতে মিশে যাবে।
বিদেশ থেকে আমদানি করা দানা বিক্রি করা হয় রাজধানীর উর্দু রোডে। সেখানে সাইদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু সাইদ বলেন, আমরা যে দানা বিক্রি করি তা সৌদি আরবের। পলি নিষিদ্ধ করা হলে এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট সবার ওপর পড়বে। তাই সরকারের এই বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত।
এখানকার আরেক ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বলেন, সরকারকে সবার আগে চিন্তা করতে হবে পলি তৈরির কারখানাগুলোতে কত মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আমার ধারণা পলির সঙ্গে সারা দেশে ১৫-১৬ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। জেলা পর্যায়েও কারখানা আছে। সেসব কারখানায় বহু শ্রমিক কাজ করেন। একজন মালিক, যিনি অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছেন। আপনাকে তার কথাও ভাবতে হবে। শুধু তার কথা নয়; রাস্তার যে টোকাই পলিথিন কুড়িয়ে বিক্রি করে, তার কথাও ভাবতে হবে। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির পেছনে যে বস্তা থাকে, কখনো চিন্তা করেছেন কেন থাকে? কারণ তিনি ওই বস্তায় আলাদা করে পলি এবং প্লাস্টিকের বোতলগুলো রাখেন। সেগুলো বিক্রি করে তার কিছু অতিরিক্ত আয় হয়। তারা ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করেন, সেখান থেকে বিভিন্ন হাতবদল হয়ে, বাছাই হয়ে, ওয়াশ হয়ে চলে আসে রিসাইক্লিং কারখানায়।
যে জিনিস রিসাইক্লিং হয়, তাতে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন আপনি বন্ধ করে দেবেন তখন তো তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এগুলো তারা কুড়াবে না-গাড়িতেই নিয়ে ডাম্পিংয়ে ফেলবে। বারবার রিসাইক্লিংয়ের কারণ ওই পলিগুলোর টেম্পার কমে যায়। ফলে ওগুলো থেকে ক্ষতির আশঙ্কা কমে যায়। একসময়ে অল্পতেই মাটিতে মিলে যায়।
এখানকার আরেক দানা ব্যবসায়ী জামাল বলেন, পলি উৎপাদন বন্ধ হলে কাঁচামাল আমদানিকারক থেকে শুরু করে টোকাই-সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পলি কোথায় না লাগে? গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে সবখানেই বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজিংয়ে পলি ব্যাগ লাগে। একটা হোটেলে যাবেন, লিকুইড জাতীয় খাবার আনতে পলি লাগবে। মাছ-মাংস বা ডাল কি আপনি পাটের ব্যাগে নিতে পারবেন? হ্যাঁ এ জন্য সরকার পলির ফুড গ্রেড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু হুট করে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক না।