প্রতিবছর রমজানের দুই-তিন মাস আগে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোটা নিয়মে পরিণত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রমজানের বাকি আছে আড়াই মাস। রমজানের আগে ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালে আনতে সরকার শুল্ক প্রত্যাহার; চাল, পেঁয়াজ ও ডিম আমদানির অনুমতি; ন্যূনতম মার্জিন বা নগদ জমার বিপরীতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার সুযোগসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে আসছে। তবে ব্যবসায়ীরা এসব সুবিধা নিলেও কমেনি পণ্যের দাম। উল্টোপথে ঘুরছে ভোগ্যপণ্যের বাজারদর। এর জন্য সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন সাধারণ ভোক্তা ও ক্যাব নেতারা।
চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, রিয়াজুদ্দিন ও পাহাড়তলী। এসব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চালে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এদিকে মাসের ব্যবধানে এলাচের কেজিতে বেড়েছে ৪০০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ২ টাকা ও সয়াবিন তেলে ১০ টাকা বেড়েছে। তা ছাড়া ছোলা, মসুর ডাল, খেসারিসহ বিভিন্ন ডাল গত বছরের এই সময়ের তুলনায় কেজিপ্রতি ৬ থেকে ৪৬ টাকা পর্যন্ত এবং সাধারণ মানের খেজুর কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরকার চাল আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, আর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী ঘুরে জানা গেছে, এসব বাজারে মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) বেতি আতপ চাল ১৫০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া জিরাশাইলে ১০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, কাটারি আতপে ২০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৮০০ ও মিনিকেট আতপে ১৫০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতি বস্তা পাইজাম আতপ ৩ হাজার টাকা, গুটি স্বর্ণা ২ হাজার ৫৫০, নূরজাহান স্বর্ণা ২ হাজার ৮০০, মিনিকেট সেদ্ধ ৩ হাজার, মোটা চাল ২ হাজার ৩০০ ও পাইজাম সেদ্ধ ২ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কোনো চাল আমদানি হয়নি। দেশের অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে যেসব চাল এসেছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে উত্তরবঙ্গে মাঠে থাকতেই নতুন ধান কিনে ফেলেছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা সেই ধানের দাম বাড়িয়ে প্রতি মণ ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। এ ছাড়া মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। চট্টগ্রামে বিক্রি হওয়া চালের ৯০ শতাংশ আসে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সেখানে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব জেলা থেকে চাল আনতে আগে ভাড়া লাগত ২০-২২ হাজার টাকা। এখন লাগছে ২৫ হাজার টাকা। এসব কারণে চট্টগ্রামে চালের বাজার চড়া।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ লাখ ৩৮ হাজার টন চিনি, ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৭০ টন পাম অয়েল, ৩ লাখ ৯১ হাজার টন সয়াবিন তেল, ২ হাজার ৬৬২ টন ছোলা, ১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৬০ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া চলতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে ৫২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে।
অথচ খাতুনগঞ্জে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে খোলা তেল। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণ খোলা সয়াবিনে ২০০ টাকা বেড়ে ৬ হাজার ৪০০ টাকা ও পাম অয়েলে ৭০ টাকা বেড়ে ৬ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে বলে দাবি করছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার ভোগ্যপণ্যের দাম অনেকটাই বেড়েছে। বাজারটিতে গত বছর এ সময়ে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ান ছোলা ৩ হাজার ১৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৪০০ টাকায়। একইভাবে প্রতি কেজি মোটা মসুর ডালে ৬ টাকা বেড়ে ৯৬ টাকা, চিকন মসুর ডালে ১২ টাকা বেড়ে ১২২ টাকা, দ্বিগুণ দাম বেড়ে খেসারি ডাল ৯০ টাকায়, কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে মটর ডাল ৫৫ টাকায়, চিকন মুগডালের কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এ সময় বাজারটিতে প্রতি কেজি সাধারণ খেজুর ৮৫০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।
তা ছাড়া গত অক্টোবরে খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হয় ৩ হাজার ১০০ টাকায়। তবে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। তবে সে সময় কোনো কোনো দোকানে ৩ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকায়।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি বছরের গত জুলাই মাসে ৪৭৮ টন, আগস্টে ২২৭, সেপ্টেম্বরে ২৩৯, অক্টোবরে ১৩০ ও নভেম্বরে ১০০ টন এলাচ খালাস হয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলছেন, মূলত ডলার রেট বাড়ার কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গত আগস্টে এলসি খুলতে ডলার রেট ছিল ১১৮ টাকা। বর্তমানে খরচ পড়ছে ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা। আর এর প্রভাব ভোগ্যপণ্যের দামের ওপর গিয়ে পড়ছে। তবে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মো. গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমরা সাধারণ ক্রেতারা তো এর কোনো সুফল পাচ্ছি না। ভোগ্যপণ্যের দাম কমার পরিবর্তে উল্টোপথে ছুটছে। আমাদের দেশে রোজা শুরুর দুই-তিন মাস আগে থেকে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়। সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘রোজাকে টার্গেট করে অসাধু চক্র এখন থেকে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এটাকে তাদের দাম বাড়ানোর পূর্বপ্রস্তুতি বলা যায়। এখন অতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে রোজার আগে অল্প পরিমাণ দাম কমিয়ে তারা সবাইকে জানাবে দাম কমেছে। এটা তাদের একটা পলিসি। আর আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রশাসন বা ভোক্তা অধিকারের কোনো অভিযান দেখছি না। এটা খুব দুঃখজনক।’