সরকার চালের দাম কমাতে আমদানিতে সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। তবে সব ধাপ পেরিয়ে দেশের বাজারে ভারত থেকে চাল আমদানি করতে আরও বেশ কয়েক দিন লাগবে। শনিবার (২ নভেম্বর) আমদানিকারক, রাজধানীর কৃষি মার্কেটসহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিলে দাম বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। রাইস মিলমালিকরাও বলছেন, অনেক মিলেই বেশি করে চাল মজুত করে রাখা হয়েছে। অভিযান চালালেই ধরা পড়বে। তখন কমবে দাম। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, দেশে বন্যায় সাত থেকে আট লাখ টন ধানের ক্ষতি হয়েছে। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খাদ্যের মজুত কম নেই।
সরকার চালের ওপর শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেওয়ামাত্র সাধারণত চালের দাম কমে যায়। এবার সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার পরও দাম কমছে না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বেনাপোল বন্দরের আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. মহসিন মিলন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরাও শুনেছি চালের ওপর থেকে সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ থাকায় খোঁজখবর নিতে পারিনি। রবিবার (আজ) খোঁজ নেব। আমদানি মূল্য, পরিবহন খরচ, লেবারসহ সব মিলিয়ে হিসাব করার পর এলসি করা হবে। কেজিতে ৫০ পয়সা লাভ পেলেই আমাদের জন্য এটা অনেক কিছু। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যাবে।’
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বেনাপোলের মিলন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। দু-চারজনকে অর্ডার না দিয়ে ওপেন করে দিতে হবে, যেন সবাই চাল আমদানি করতে পারে। তাহলে চালের দাম কমে যাবে। বৃহত্তর যশোরে দুই হাজার লোক আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে প্রতিয়োগিতা শুরু হলে ভোক্তারা কম দামে সব পণ্য পাবেন। মাত্র ২ ঘণ্টায় বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে সব পণ্য চলে আসে। তাই চালও দ্রুত ঢাকায় চলে যাবে।’
রাজধানীতে চালের পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ও বাদামতলী। গতকাল সরেজমিনে কৃষি মার্কেটে দেখা যায়, প্রায় সব দোকানেই সারি সারি সাজানো চালের বস্তা। এই বাজারের মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মাহাবুবুর রহমান সোহেলের কাছে চালের দাম বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরাও শুনেছি চালের ওপর সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার। এটা কার্যকর হলে চালের দাম কেজিতে প্রায় ১০ টাকা কমে যাবে। এটা ভালো দিক। সম্প্রতি চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে। দেশে বন্যা হয়েছে। অনেক জেলা ডুবে গেছে। আমনের ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে ধানের দাম বেশি। এ জন্য কমে না চালের দাম।’
এই বাজারের অপু এন্টারপ্রাইজের জাহিদ হোসেন বলেন, ‘চাল এখনো আসেনি। ধানের দামও বেশি। এ জন্য চালের দাম চড়া। ভারতের কম দামের চাল এলে দাম কমে যাবে। আমরাও বিক্রি করতে পারব। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে মিনিকেট চাল ৬৩-৬৮ টাকা, আটাশ ৫৮-৫৯ টাকা ও গুটি স্বর্ণা ৪৮-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সেই চাল খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। এই বাজারের খুচরা বিক্রেতা সৈকত আলী বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই বাড়ছে চালের দাম। মিনিকেট ৭০-৭৮ টাকা কেজি, আটাশ চাল ৬২ ও গুটি স্বর্ণা ৫২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় বন্যায় ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য অনেক মিল চাল মজুত করে রাখছে। তাদের সিন্ডিকেটেই বাড়ছে দাম। ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল এলে দাম কমে যাবে।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির তথ্যও বলছে, দেশে বর্তমানে চালের দাম বেশি। সর্বশেষ তথ্যমতে, ৩১ অক্টোবর সরু চাল ৭০-৮০ টাকা কেজি, মাঝারি ৫৮-৬৫ ও মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। যেখানে গত বছরের একই সময়ে এই দাম ছিল যথাক্রমে ৬০-৭১, ৫২-৫৫ ও ৪৮-৫২ টাকা কেজি। পাইকারি ও খুচরা চাল বিক্রেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘সব মিলার লাভ বেশি করে এটা মিথ্যে কথা। খুচরা বিক্রেতারাই বেশি লাভ করে। এ ছাড়া সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্রের লোক নেই। পথে চাঁদাবাজ নেই। পুলিশ নেই। কিন্তু সিন্ডিকেট থেকেই গেছে। বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের লোক সেই জায়গা করে নিয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করেই চাল মজুত করে রেখেছে।’
ধানের কেমন ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. এমদাদ উল্লাহ মিয়াঁ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবার দেশের উত্তর-দক্ষিণে বন্যায় আউশ ও আমনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। ফলে দেশে সাত থেকে আট লাখ টন ধানের উৎপাদন কম হবে। তবে এই ঘাটতি মেটাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এনবিআর থেকে চাল আমদানিতে সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে (অগ্রিম আয়কর) নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে কেজিতে প্রায় ১০ টাকা দাম কমবে। অগ্রিম রবিশস্য উৎপাদনেও তৎপরতা চালানো হচ্ছে। চাল ও গমের মুজত রয়েছে। চালের বিকল্প বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। তাই আশা করি সমস্যা হবে না।’
এদিকে খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে এটা সত্য। তবে খাদ্য মজুতও কম নেই। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে গতকাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন গুদামে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল ৯ লাখ ৮০ হাজার টন ও গমের মজুত ৪ লাখ ৫০ হাজার টন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গত বছরও খাদ্য মজুত প্রায় এ রকমই ছিল।’
আমদানিকারকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য সচিব বলেন, ‘ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে পিপিআর ২০০৮ আইন ফলো করে খাদ্য আমদানি করা হচ্ছে। কোনো মনোপলি হচ্ছে না। যে কেউ চালসহ খাদ্য আমদানি করতে পারবেন।’
আরও পড়ুন জেলায় জেলায় চালের বাজার
কুষ্টিয়াতে মিলারদের কারসাজিতেই বাড়ছে চালের দাম
মজুতদারদের কারণেই চড়া চট্টগ্রামের চালের বাজার