ডান চোখে কিছুই দেখেন না। বাম চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা। ছিঁড়ে গেছে চোখের নার্ভ, কর্ণিয়া, রেটিনা। ফেটে গেছে মণি। মাথায় ৯টি রাবার বুলেটের ক্ষত। এসব নিয়ে চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ইসমে আজম। গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হন তিনি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার চোখের অবস্থা এর চেয়ে আর ভালো হবে না। এক চোখে দেখতে পাবেন না তিনি। বাম চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। এরই মাঝে দেখা দিয়েছে কোমরের সমস্যা। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। গত ২০ দিনের মতো তিনি হাঁটাচলা করতে পারছেন না। হুইলচেয়ারই ভরসা।
গার্মেন্টকর্মী বাবা-মায়ের খুব আদরের ছেলে আজম। তার বড় একটি বোন আছে। নাম কানিজ ফাতেমা। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে চাকরি করবে। শেষ বয়সে হয়তো একটু স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু না। গাজীপুর সরাদগঞ্জ গ্লোরিয়াস মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমের লেখাপড়া অনিশ্চিত। তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরারও নিশ্চয়তা নেই। লেখাপড়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। আজমসহ পরিবারের সবার স্বপ্ন এখন ঝাপসা হয়ে গেছে।
ইসমে আজম দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দক্ষিণ মরনাই গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তার পরিবারের সবাই ঢাকার গাজীপুরের শ্রীপুর হাজি মার্কেট এলাকায় বাস করেন। আজমের মা-বাবা দুজনই গার্মেন্টকর্মী। মা আছেন প্রোডাকশনে। কাজ করলে বেতন, না করলে নেই। বাবা গার্মেন্টের অপারেটর। আজম আহত হওয়ার পর তার প্রভাব পড়েছে পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে। বেশির ভাগ সময় আজমকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে ঠিকমতো চাকরি করতে পারছেন না তার মা। বেশির ভাগ সময়ে তাকেই থাকতে হচ্ছে ছেলের কাছে। কখনো বাবা থাকছেন ছেলের পাশে, মা যাচ্ছেন কর্মস্থলে। এভাবেই চলছে তাদের দিন।
গত ১ নভেম্বর পিজি হাসপাতালের কেবিন ব্লকে গিয়ে দেখা যায় হুইলচেয়ারে দক্ষিণমুখী হয়ে বসে আছেন ইসমে আজম। তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। দীর্ঘসময় ধরে কথা হয় আন্দোলনে সক্রিয় এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
গত ১৪ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। গাজীপুরের বাসা থেকে আন্দোলনে অংশ নিতে প্রতিদিন যেতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করে বাসায় ফিরতেন। কেউ তাকে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা বলেনি। তিনি নিজেই আন্দোলনে যুক্ত হন।
২৮ জুলাই, সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হন আজম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছান বেলা ১১টায়। কর্মসূচি পালন করে বেলা আড়াইটার দিকে বাসার উদ্দেশে রওনা হন। তার সঙ্গে আরও ৩০ থেকে ৪০ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছিলেন। বাইপাইল মোড়ের সামনে এসে দেখেন সেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। সঙ্গে পুলিশও আছে। ভয়ে আজমরা সবাই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সবাই দৌড়ে চলে যেতে পারলেও আজম পারেননি। পুলিশ বা ছাত্রলীগের কেউ আজমকে লক্ষ্য করে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প ছুড়ে মারে। স্ট্যাম্প পায়ে এসে লাগে। তিনি পথের ওপর পড়ে যান। ছাত্রলীগের কয়েকজন আর পুলিশ এসে আজমকে ওই স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে ও পদপিষ্ট করে অনেকটা নিস্তেজ ফেলে রেখে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর অপরিচিত একজন লোক আজমকে পাশের ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়ে ওষুধ কিনে দেন। এরপর আজম বাসায় ফেরেন। এরকম আহত শরীর নিয়েও প্রতিদিন তিনি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালানোর আগ মুহূর্তে বিজয় মিছিলে অংশ নেন ইসমে আজম। মিছিল আশুলিয়া থানার সামনে এলে পুলিশ খুব কাছে থেকে গুলি করে। আজমের চোখে রাবার বুলেট লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে যান। পরে তার বন্ধু আশরাফুল তাকে চান্দুরার কাছে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাকে শুধু একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বাবাও পৌঁছে যান হাসপাতালে।
ওখান থেকে আজমকে নেওয়া হয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। ওই রাতেই সেখানে তার চোখের সার্জারি হয়। সাত দিন পরে ফলোআপে এলে হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়। ততদিনে চোখে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গেছে।
হাসপাতালে চার দিন রাখার পর ৩১ আগস্ট তাকে পিজিতে পাঠায়। ৪ সেপ্টেম্বর আবার চোখের অপারেশন হয়। ৭ সেপ্টেম্বর রিলিজ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। বাসায় যাওয়ার পর আজম কোমরে ব্যথা অনুভব করতে থাকে। সেই ব্যথা দিন দিন বাড়তে থাকে। দশ দিন পর আবার পিজিতে ভর্তি হন। কোমরের ব্যথা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। ব্যথাটা শুরু হতো হঠাৎ-হঠাৎ। কিন্তু যখন ব্যথা শুরু হতো তখন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দিত। এরকম পরিস্থিতিতে তাকে পিজির আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে আজম ছিলেন পাঁচ দিন। অবস্থার একটু উন্নতি হলে আইসিইউ থেকে বের করে কেবিনে নেওয়া হয়। ততদিনে আজম হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তার সঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। এরপর সিএমএইচেও তাকে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এক দিন এসডিইউ এবং এক দিন আইসিইউতে ছিলেন। এভাবে তিনি সিএমএইচে ছিলেন পাঁচ দিন। সেখান থেকে পরে থেরাপি দেওয়ার জন্য পাঠানো হয় সাভারের সিআরপিতে।
সিআরপিতে যাওয়ার পর প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকলে অক্সিজেন দিয়ে সারারাত রাখা হয়। গত ২৮ অক্টোবর তারা নিউরো সার্জারির চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শ দিয়ে পিজিতে পাঠিয়ে দেয়। গত ৩১ অক্টোবর থাইল্যান্ডের এক চিকিৎসকদল এসে আজমকে দেখেন। তারা কিছু টেস্ট করানোর কথা বলেন। টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার পর আজমের চিকিৎসার বিষয়ে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
ইসমে আজম জানালেন, ‘আমার চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করছে। তবে বারবার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়া-আসা করার খরচ নিজেরই বহন করতে হচ্ছে।’ শুধু সিআরপিতে যাওয়া-আসার জন্য তিনি অ্যাম্বুলেন্স পেয়েছিলেন। অন্য আনুষঙ্গিক খরচ পরিবারকেই বহন করতে হচ্ছে।
দেশবাসীর কাছে আজম দোয়া চেয়েছেন, ‘সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন পুরোপুরি দুই চোখের দৃষ্টি ফিরে পাই। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারি। যেন ফিরে পাই আগের স্বাভাবিক জীবন।’