সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৯ বছরে ১৬৪টি দলিলে বিশাল ওই সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। ২০১৭ সালেই ৬১টি দলিলে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ কেনেন।
এর মধ্যে ঢাকার গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও প্লট। বসুন্ধরা শপিংমলেও রয়েছে একটি দোকান। এ ছাড়া কুমিল্লার মেঘনা থানার ৮টি মৌজায় প্রায় ১০০ একর জমি কিনেছেন। কক্সবাজারের একটি আবাসিক হোটেলের আংশিক মালিকানা রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৬৭০টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে প্রায় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সর্বশেষ ৬৯ কোটি টাকা স্থিতি রয়েছে।
সেলিনা ইসলামের কেনা বিশাল সম্পত্তির ১৬০টি দলিলের মধ্যে ২০১১ সালের ১৩টি ও ২০১২ সালের ৫টি দলিল এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এছাড়া ২০১৩ সালের একটি, ২০১৪ সালের ৪টি, ২০১৫ সালের ১৬টি, ২০১৬ সালের ২৯টি, ২০১৭ সালের ৬১টি, ২০১৮ সালের ২৩টি এবং ২০১৯ সালের ১২টি দলিল পাওয়া গেছে। এসব দলিলে যে মালিকানা রয়েছে সেগুলো হলো ঢাকার গুলশান-২ নম্বরে ৯৫ নম্বর রোডের সিইএন নামের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দোতলায় (ডি/২) প্রায় ৩ হাজার স্কয়ার ফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘ডি’ ব্লকে ৮ নম্বর রোডে ৪৭৭ নম্বর প্লটে ৮ তলার বিশাল অট্টালিকা, পান্থপথে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে ১৫১ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান, বারিধারায় ৫ কাঠার একটি প্লট, উত্তরার দক্ষিণখানে সাড়ে ৭ কাঠা করে দুটি প্লট, যাত্রাবাড়ীতে ৬ কাঠার একটি প্লট, কক্সবাজার জেলা শহরে একটি আবাসিক হোটেলের শেয়ার। এ ছাড়া কুমিল্লার মেঘনা থানার নারায়ণপুর, বলরামপুর, বড়লক্ষ্মীপুর, সেনেরচর, সোনাকান্দা, চালিভাঙ্গা, লুটেরচর ও মানিকারচর মৌজায় বাড়িভিটাসহ প্রায় ১০০ একর জমি কিনেছেন। সেখানে দোতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত অন্তত ৮টি বাড়ি রয়েছে। এক-একটি দলিলে ২ একর থেকে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ জমি রয়েছে।
এদিকে দুদক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২০ সালের জুলাই মাসে তলব করেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দীন। অনুসন্ধান শেষে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৭ জুন মামলা করা হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারের উচ্চ মহলের প্রভাবে সেই তদন্তকাজ এগোয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর তদন্তকাজ সচল হয়। বর্তমানে দুদক পরিচালক মোয়ানেম হোসেন মামলাটির তদন্ত করছেন। শিগগিরই সেলিনা হোসেনের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ ফ্রিজ ও ক্রোকের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করা হবে।
২০১৬ সালের আগে কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে চিনতেন না কেউ। অথচ সেই কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলই লক্ষ্মীপুরের রায়পুরায় ‘টাকা ছড়িয়ে’ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন এবং লক্ষ্মীপুর-২ আসনে (রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর মানব পাচার ও ঘুষ লেনদেনের দুটি মামলায় ২০২১ সালে কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদ হারান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪৯-এর সংসদ সদস্য করা হয়।
কুয়েত আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দেওয়া পাপুল ২০১৭ সালে দেশে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদের ফরম পূরণ করেন। এমপি হওয়ার পর ২০১৯ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সদস্যপদ পান। নিজের পাশাপাশি স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়েকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বরে সদস্য করেন। সেলিনা ইসলামের পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায় এই তিন বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ কেনা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।