ঢাকা ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি কমিশন গঠনে শঙ্কা

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৩ পিএম
প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি কমিশন গঠনে শঙ্কা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বাংলাদেশের ১৪তম নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ অক্টোবর ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। কিন্তু ২০২২ সালে করা বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কারের আগেই এই কমিটি গঠন হওয়ায় এবারও ইসিতে যথাযথ ব্যক্তিদের মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে যে আইনেই গঠিত হোক, এবারের সার্চ কমিটি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনের পরও আইনি সংস্কারে কোনো বাধা নেই। তার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কারকাজ একসঙ্গে এগিয়ে নিতে চলমান আইনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়েই গঠিত হবে নতুন নির্বাচন কমিশন।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের আগে কোনো ধরনের আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা অনুসারে তখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হতো। ২০২২ সালের আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে একটি সার্চ কমিটি হলেও তার ফলাফল ছিল ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন কমিশন। পরবর্তী সময়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠিত হয়, সেটিও একটি প্রহসনের নির্বাচন উপহার দেয়। ফলে পুরোনো আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে এবারে কেমন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় এবং তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে কতটা ভালো নির্বাচন উপহার দেয়, তার ওপরেই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে। 

তারা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ হলো ইসি গঠনের সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ। আর ২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিদ্যমান আইনটি নানা মহলে বিতর্কিত। কারণ আইনটিতে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রস্তাব পাওয়ার আগেই কেন তাড়াহুড়ো করে সার্চ কমিটি গঠন করা হলো তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে। অনেকে বিতর্কিত আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নতুন ইসি কমিশন গঠন হলে নতুন করে বিতর্ক উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। 

২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা আইনটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশীদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওই আইনে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। সেটি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ আইন-২০২২’ নয়; শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২’। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে পূর্ণাঙ্গ আইন তথা ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২৪’ প্রণয়ন করা জরুরি ছিল। অথচ সেটি না করে ওই আইনেই সার্চ কমিটি করা হলো। এতে নতুন ইসি কমিশনে যথাযথ ব্যক্তির মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেল। নতুন আইন হলে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী ইসির কাজ, সংবিধান নির্দেশিত ক্ষমতার প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের নানা আইনি ও আইনবহির্ভূত রাজনৈতিক বাধা দূর হতো। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিধানাবলি সংযোজন, কমিশনের অর্থায়ন, নিয়োগ, নির্বাচনকালে নিজ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট আইনি বিধান সংযুক্ত করা দরকার ছিল। আর সেটা হলে কমিশন যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তাদের সাহসী সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সক্ষম হতো বলে মনে করি।’ 

ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থার আইনি সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠনের বিধান করা। যতটুকু জানি সংস্কার কমিশন বিতর্কিত আইনটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব তৈরি করছে। অথচ সেই প্রাথমিক পদক্ষেপে সরকার তাড়াহুড়ো করায় জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আর সংস্কার কমিশন তার রিপোর্ট শেষ করার আগেই পুরোনো আইনে সার্চ কমিটি গঠন হওয়ায় বোঝা গেল এখনো কোনো সংস্কার বাস্তবায়িত হয়নি। এটি সংস্কার কমিশন এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। তারপরও বলতে চাই, যেহেতু সার্চ কমিটি হয়েছে, তাই নির্বাচনি সংস্কার কমিশন যেন একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় করতে সার্চ কমিটিকে সহযোগিতা করে। নতুন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়ায় যেন স্বচ্ছতা থাকে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের মতামতকে যেন প্রাধান্য দেওয়া হয়।’

রাজনৈতিক দলগুলোও চলমান আইনের সমালোচনা করে তা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিল। এই আইন পাসের আগে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও গণফোরামের ১২ জন সংসদ সদস্য ৭৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছিল, যার সবই ছিল মূলত শব্দগত পরিবর্তন। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি।

সার্চ কমিটি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সিইসিসহ কমিশনাররা তো অনেক দিন আগেই পদত্যাগ করেছেন। ফলে সরকার চাইলে এই কমিটি অনেক আগেই করতে পারত। একই সঙ্গে নির্বাচনের অন্যান্য প্রস্তুতিও নেওয়া যেত। দেশের জনগণ নির্বাচন চায়। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এখনো যদি সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে, তাহলে দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। তাই সংস্কার ও নতুন ইসি কমিশন গঠনের পাশাপাশি সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি।’ 

সার্চ কমিটি গঠনকে সরকারের ইতিবাচক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ইসি গঠনে আইনি পুরোনো সব ফাঁকফোকর রয়েই গেল। এখনো যদি বিদ্যমান আইনেই সার্চ কমিটি করা হয়, তাহলে এতসব সংস্কার উদ্যোগের উদ্দেশ্য কী ছিল? এই কমিটি গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তাড়াহুড়ো করে গঠিত এই সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত কমিশন সম্পর্কে জনগণের উদ্বেগ পুরোপুরি সমাধান কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’

এদিকে যে আইনেই গঠিত হোক না কেন, এবারের সার্চ কমিটি নিয়ে আশাবাদী সংস্কার কমিশন। কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা অত্যন্ত সম্মানিত এবং সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। আশা করি এই কমিটির সদস্যরা নতুন নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করবেন।’ 

বর্তমান আইনটি প্রকৃতপক্ষে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি সংস্কারের বিকল্প নেই। সার্চ কমিটি তার নিজস্ব গতিতে কাজ করবে এবং আমরা আমাদের মতো কাজ করব। যে প্রস্তাবগুলো দেব তার কিছু সরকার এবং কিছু নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করবে। তাই সার্চ কমিটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় ওই কমিটি গঠনের পর সংস্কারে কোনো বাধা নেই। সার্চ কমিটি আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে।’ 

সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। তবে বলতে পারি আইনে বিদ্যমান সব ঘাটতি পূরণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কারে আমাদের লক্ষ্য, অংশীজনদের (রাজনৈতিক দল) কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রস্তাব তৈরি করা।’

আইনি সংস্কারের আগেই কেন সার্চ কমিটি- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘উদ্বেগ সম্পর্কে আমরা অবগত। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কাজ একযোগে এগোবে। যদিও সংস্কারকাজ চলছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও এগিয়ে নিতে হবে। কারণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কাজে সময় বাঁচাতে আমরা সার্চ কমিটি গঠন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় সব রাজনৈতিক দল সময়মতো নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আমরাও সময় বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলমান আইনে গঠিত হলেও এবারের সার্চ কমিটিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সবার পরিচিত, জ্ঞানী এবং নিরপেক্ষ। তাদের লক্ষ্য সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন প্রার্থীদের মনোনীত করা; যারা সবার কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করা।’

গত আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ৯০ দিন আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কমিশনকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে প্রস্তাবিত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। একই মাসে গত ৩১ অক্টোবর, সরকার হঠাৎ করে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর অধীনে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। 

২০২২ সালে করা আইনে প্রথম গঠিত হয় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক মাসের মাথায় শিক্ষার্থী-জনতার চাপের মুখে ৫ সেপ্টেম্বর বিদায় নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন, যাদের অধীনে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল।

লক্ষ্মীপুরে দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশত সন্ত্রাসী বাহিনী

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১০ পিএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
লক্ষ্মীপুরে দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশত সন্ত্রাসী বাহিনী
লক্ষ্মীপুর

সন্ত্রাসের জনপদখ্যাত লক্ষ্মীপুরে এখনো দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশতাধিক বাহিনীর দুই হাজারের বেশি সন্ত্রাসী। চলছে দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধ। এই সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এরা নির্বিঘ্নে করছে এসব অপরাধ।

এসব বাহিনীর অনেকে বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ নানা মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি হলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং তারা কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ভুক্তভোগী থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে আর এই সুযোগে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো এলাকায় ফিরে এসে বীরদর্পে তাদের অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় একসময় শতাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী রাজত্ব চালায়। সে সময় অনেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে হতাহত হন। আবার অনেকেই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।

২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর ভূমিকার কারণে এসব সন্ত্রাসী বাহিনী সাময়িকভাবে দমে ছিল। পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী জিসান বাহিনীর প্রধান সোলেমান উদ্দিন জিসান, দিদার বাহিনীর প্রধান দিদার, সোলেমান বাহিনীর প্রধান সোলেমান, নাছির বাহিনীর প্রধান নাছির, শামীম বাহিনীর প্রধান শামীম, সেলিম বাহিনীর প্রধান সেলিম, বাবুল বাহিনীর প্রধান আসাদুজ্জামান বাবুল, লাদেন বাহিনীর প্রধান মাসুম বিল্লাহ ওরফে লাদেন মাসুমসহ কয়েকজন বাহিনীপ্রধান নিহত হন। এ ছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নিহত হন মনির বাহিনীর প্রধান মনির, আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনোয়ার, মামুন বাহিনীর প্রধান মামুন, ভুলু বাহিনীর প্রধান ভুলু, গুল কামাল বাহিনীর প্রধান কামাল হোসেন, সাফু বাহিনীর প্রধান সাফু, নোমান বাহিনীর নোমান, আলাউদ্দিন বাহিনীর প্রধান আলাউদ্দিন, রতন বাহিনীর প্রধান রতন, মুন্না বাহিনীর প্রধান মোসলেহ উদ্দিন মুন্নাসহ আরও কয়েকজন বাহিনীপ্রধান নিহত হন। 

এসব বাহিনীর প্রধানরা নিহত হলেও তাদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি। পুলিশ প্রশাসনও অস্ত্রগুলো উদ্ধারে তৎপর হয়নি। প্রধানদের মৃত্যুর পর সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর তৎপরতা সাময়িকভাবে থেমে গেলেও পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ বাহিনীর নেতৃত্ব দলের অন্য কেউ গ্রহণ করে তৎপরতা শুরু করে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয়তার কারণে দিপু বাহিনীর প্রধান মাহমুদুল করিম দিপু, তাজু বাহিনীর প্রধান তাজুল ইসলাম মেম্বার, টাইগার বাহিনীর প্রধান ওমর ফারুক, হিরো বাহিনীর প্রধান হিরো চৌধুরী, আমির বাহিনীর প্রধান হাজি আমির হোসেনসহ কয়েকটি বাহিনীর প্রধান তাদের বাহিনী বিলুপ্ত করে অপরাধ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৫০টির বেশি সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের কারও কারও মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা থাকলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

জানা যায়, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের পূর্বাঞ্চলের ত্রাস জিসান বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের লতিপুর গ্রামের কাউসার ওরফে ছোট কাউসার। কাউসারকে মামুন বাহিনীর প্রধান মামুন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন, জামাই ফারুক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। হত্যাসহ বিচারাধীন আরও এক ডজনের বেশি মামলা। এ বাহিনীর হাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর কাউসারের নেতৃত্বে জিসান বাহিনী এলাকায় অপহরণ, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধ করে যাচ্ছে। 

একই এলাকায় কাজী বাবলু বাহিনী তৎপরতা চালিয়ে গেলেও সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর এ বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে আছে। এ বাহিনীর হাতে রয়েছে দুই ডজনেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র। ডাকাত নাছির বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো কাজী বাবলুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এই এলাকায় আরেক সন্ত্রাসী বাহিনী হলো নিকু বাহিনী। এই বাহিনী এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। নিকু বাহিনীর নিকুর বিরুদ্ধে দুটি হত্যা, অস্ত্রসহ বেশ কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সদর উপজেলার হাজীরপাড়ায় তৎপর রয়েছে নিজাম উদ্দিন মুন্না বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান নিজাম উদ্দিন মুন্না একটি অত্যাধুনিক জি-থ্রি অস্ত্র ও ২০০ রাউন্ড বুলেটসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে যুবলীগের সংঘর্ষ চলাকালে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে এ বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে এসে যুবলীগকে সহযোগিতা করে। এই সংঘর্ষে চারজন মেধাবী ছাত্র নিহত হন। 

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এর মধ্যে জিহাদি বাহিনী, নোমান বাহিনী, লাদেন বাহিনী এলাকায় বেশ সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জিহাদি বাহিনীর হাতে নোমান বাহিনীর প্রধান নোমান ও তার সহযোগী রাকিব নিহত হওয়ার পর জিহাদি পালিয়ে যান। এখনো তার বাহিনীর অন্য সদস্যরা এলাকা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন ফয়সাল দেওয়ান। লাদেন বাহিনীর প্রধান মাসুম বিল্লাহ লাদেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বালাইশপুর গ্রামের বারাকাত। আর নোমান বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন রাকিব হোসেন প্রকাশ ওরফে ভাগিনা রাকিব। এই এলাকার আরেক বাহিনীর নাম কিরণ বাহিনী। কিরণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন নন্দীগ্রামের সাতবাড়ির সিরাজউল্লার ছেলে মুরাদ। দত্তপাড়া ইউনিয়নে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাহিনী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শামীম বাহিনী। এ বাহিনীর প্রধান শামীম বাবলু বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্রীরামপুর গ্রামের মো. কাউসার। এই এলাকায় বর্তমানে নোব্বা বাহিনীর নবীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে। এই এলাকার আজিজ বাহিনী, ইসমাইল বাহিনী, হুমা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র থাকলেও তাদের এখন দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।

সদর উপজেলার বাংগাখাঁ ইউনিয়নে রয়েছে মাওলা বাহিনী, লেংলা ফরহাদ বাহিনী, পিচ্চি আনোয়ার বাহিনী, শাহজাহান মেম্বার বাহিনী। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে শাহজাহানের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সদস্যরা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনার পর থেকে শাহজাহান ও তার বাহিনীর সদস্যরা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। এই বাহিনীগুলোর কাছে রয়েছে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুরে বর্তমানে তৎপর রয়েছে কদু আলমগীর বাহিনী ও জিহাদি বাহিনী। ৫ আগস্টের পর দুই বাহিনীর মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। কদু আলমগীর নোমান হত্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর এলাকায় এসে আবার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলছেন। গত মাসের শেষ দিকে কদু আলমগীর তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ইউনিয়নের দক্ষিণ মাগুরী মতার হাটের নূরনবীর মুদি দোকানে গুলি চালিয়ে দোকানের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে যান। 

সদর উপজেলার দিঘলি ইউনিয়নে তৎপর রয়েছে আজগর ও সোহেল বাহিনী। মান্দারী ইউনিয়নে রয়েছে তালেব ও রুবেল বাহিনী। চরশাহী ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি বাহিনী বিগত সময়ে তৎপর থাকলেও বর্তমানে রিয়াজ বাহিনী, মিঠু-মিল্লাত বাহিনী অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কুশাখালী ইউনিয়নে রয়েছে হেডম জাহাঙ্গীর বাহিনী, ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে বিপ্লব বাহিনী, রাসেল বাহিনী, চররুহিতায় জহির বাহিনী, আবুল খায়ের বাহিনী, কালা বাচ্চু বাহিনী, চররমনী মোহনে কামরুল সরকার বাহিনী, ইউছুফ ছৈয়াল বাহিনী, মোল্যাহ বাহিনী, আলমগীর মেম্বার বাহিনী, দালাল বাজারে নুরনবী চেয়ারম্যান বাহিনী, দক্ষিণ হামছাদিতে ফরিদ বাহিনী, বাহার বাহিনী এবং লক্ষ্মীপুর পৌরসভা এলাকায় তাহের বাহিনী ও টিপু বাহিনীর তৎপর রয়েছে। 

এদিকে বশিকপুরে কয়েকটি বাহিনীর সমন্বয়ে একটি বাহিনী গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের কাছে এ বাহিনী মিশ্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন আলামিন নামের এক সন্ত্রাসী। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০-এর বেশি। তারা প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বশিকুর মাদ্রাসার পূর্ব পাশে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। বিভিন্ন ব্যক্তিকে এখানে ধরে এনে চাঁদা আদায় করে থাকে এবং এখান থেকে তারা ভাড়ায় সন্ত্রাসী কাজ করতে যায়। এই এলাকার পোদ্দার বাজারের পুলিশ ফাঁড়ি সব জেনেও অপরাধ দমনে সক্রিয় হয় না।

স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসীরা এলাকায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন মামলায় বাহিনীর প্রধান ও সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের কাছ থেকেও অস্ত্রগুলো উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই।

লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন সচেতন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবর কাগজকে জানান, এসব সন্ত্রাসী বাহিনী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় শেল্টারে থাকায় তাদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা দেখায় না। দলীয় আশ্রয়ে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের হাতে নির্যাতিত হয়েও মুখ খুলতে সাহস পায় না। 

লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. শাহাবুদ্দিন সাবু খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপি কখনো সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রশ্রয় দেয় না। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে বিগত ১৭ বছরে বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। শত শত নেতা-কর্মী আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। তিনি অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্রগুলো উদ্ধারের দাবি জানান।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নূরনবী ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না। তাদের দলে কোনো সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী ও খারাপ লোক নেই। তিনি লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য দাবি জানান। 

লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার আখতার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সন্ত্রাসী বাহিনীর ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন তথ্য পুলিশের কাছে নেই। 

তিনি জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত-নিহতদের পরিবারের দায়ের করা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর ও রামগঞ্জ থানার লুণ্ঠিত অস্ত্রের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। 

বোঝার ওপর শাকের আঁটি ইচ্ছামতো বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়া

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
ইচ্ছামতো বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়া
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দেশে মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার জোটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত- সবকিছুতেই খরচ বাড়ছে। এর সঙ্গে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো যোগ হয়েছে বাড়ি ভাড়া। নতুন বছর আসতে না আসতেই ভাড়া বাড়ানোর হিড়িক পড়েছে।

রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অল্প আয়ের মানুষের ৪-৫ হাজার টাকার আধা-পাকা বাড়িরও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার সাধারণ মানের বাসার ভাড়া ১ থেকে ২ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। একটু ভালো মানের ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বাড়ির ভাড়া এক ধাক্কায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা জানা গেছে।

ফ্ল্যাট ভাড়া, বিক্রি বা লিজের ব্যাপারে অন্যতম সন্ধানদাতা প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টির তথ্য অনুসারে, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক, ধানমন্ডি, বনশ্রী ও রামপুরায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৪ থেকে ২০ শতাংশ। বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।

সাধারণ মানুষের গলা চেপে ধরে এভাবে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অমানবিক জানিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, এ দেশে যারা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, ব্যবসায়ী। এদের বেশির ভাগই ঘুষ বা অনৈতিক উপায়ে আয় করে একাধিক বাড়ি বানিয়ে ভাড়া তুলছেন। নিজের পকেট ভারী করাই অন্যতম উদ্দেশ্য। ভাড়া বাড়ানোয় ভাড়াটিয়ারা কতটা ভোগান্তিতে পড়ছেন, তা নিয়ে চিন্তা করেন না। এসব বাড়ির মালিক বেশির ভাগ কর ফাঁকি দেন। এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ আইনি জটিলতা ও ঝামেলা হবে এমন আশঙ্কায় এসব প্রভাবশালী বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে যান না বললেই চলে। 

তিনি বলেন, ‘এর বাইরেও কিছু মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বানিয়ে ভাড়া দেন। এদের সংখ্যা অনেক কম। খোঁজ নিয়ে দেখবেন এসব ব্যক্তি সাধারণ ভাড়াটিয়ার ওপর তুলনামূলক কম চাপ দেন।’ 

মিরপুর-১৩ নম্বরের বিজয় রাকিন সিটিতে ২৪ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন চাকারিজীবী রিয়াজ রহমান। ২৫ নভেম্বর তার ফ্ল্যাটের মালিক ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ভাড়া ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩৪ হাজার টাকা করার কথা জানিয়েছেন।

রিয়াজ রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বছরের শুরুতে আমার বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে ৫৫ হাজার টাকা হয়েছে। এই বেতনে খাবার, ডাক্তার-ওষুধ, যাতায়াত, ছেলেমেয়ের পড়াসহ সংসারের খরচ করে ২৪ হাজার টাকার বাসা ভাড়া দিতেই কষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ধারদেনা করি। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো অমানবিক।’ 

রিয়াজ রহমান বলেন, ‘বাড়ির মালিক জানিয়ে দিয়েছেন বাড়তি ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছাড়তে হবে। বিভিন্ন মোবাইল নম্বরের নগদ বা বিকাশে ভাড়া নেন। ভাড়া পরিশোধের কোনো রসিদ দেন না।’ 

সরেজমিন রাকিন সিটিতে গিয়ে দেখা যায়, একই আকার ও মানের বাসার ভাড়া বিভিন্ন রকম। কোনোটির ২৫ হাজার, কোনোটির ৩৫ হাজার বা ৪০ হাজার টাকাও চাওয়া হচ্ছে। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এ এলাকার বেশির ভাগ ফ্ল্যাটের মালিক ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। শুধু এ এলাকা নয়, রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে কোনো ভাড়াটিয়া বাড়তি ভাড়া দিতে সক্ষম না হলে নানা অজুহাতে নামিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় হুমকি-ধমকি দিয়েও বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। 

রাজধানীর বাড্ডায় অসুস্থ শাশুড়ি ও এক মেয়ে নিয়ে ১৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর নাহার। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্বামী মারা গেছেন। আমি রঙের কারখানায় কাজ করি। কারখানা আর মেয়ের স্কুল কাছেই বলে এখানে থাকি। গত বছর ভাড়া বাড়িয়েছে ১ হাজার টাকা। দুই বছর পর ভাড়া বাড়ানোর কথা থাকলেও এই বছর আবারও ১ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছেন। এই এলাকায় বাড়িওয়ালার ছয়তলার দুটি বাড়ি। তার সব ফ্ল্যাটেই গড়ে ১/২ হাজার টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছেন। তার ভাই লোকজন নিয়ে এসে বলে গেছেন, বাড়তি ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।’ 

এ খবরে দিশেহারা ভাড়াটিয়ারা। ভাড়া কিছুটা কম বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেও তা কাজে আসছে না। উল্টো বাড়তি ভাড়া দিতে না পারায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছেন। এলাকার প্রভাবশালীদের দিয়ে বাসা ছাড়তে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়ি ভাড়া সূচকে পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা ও ঝুপড়ি ঘর- তিন ধরনের বাড়ির ভাড়া বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। কাঁচাঘরের ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ক্রমবর্ধমান বাড়ি ভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এই বাড়তি খরচ কম আয়ের পরিবারগুলোর বোঝা দ্বিগুণ করে দেয়। 

খুলনার বাগমারা এলাকায় আধা-পাকা ঘরে ভাড়া থাকেন কাঠমিস্ত্রি সুখেন সাহা। খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওপরে টিন, মেঝে পাকা, দুই রুমের ভাড়া ৪ হাজার টাকা। এবার ৮০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পরিবার নিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনবেলা খাবার জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যায়। ভাড়া বাড়ালে কেমনে কী করব!’

বাড়িওয়ালাদের বেশির ভাগই ভাড়া পরিশোধের রসিদ দেন না। অনেকে রসিদ দিলেও তাতে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে কম দেখানো হয়। এখন অনেক বাড়িওয়ালা বিকাশ বা নগদে ভাড়া নিচ্ছেন। ঠিক কত ভাড়া দিচ্ছেন তার প্রমাণ হিসেবে রসিদ না থাকায় অনেক ভাড়াটিয়া আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না। 

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীম আল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, বছরের শুরুতেই বিবেকহীনভাবে ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক ভাড়াটিয়া আইনি জটিলতায় বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন না। অথচ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বাড়িওয়ালা যখন-তখন ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে ভাড়া ঠিক করতে হবে। দুই বছরের আগে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না। 

আইন অনুযায়ী, ‘বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ দণ্ডিত হবেন। বাড়িওয়ালা এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম হিসেবে নিতে পারবেন না। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে লিখিত চুক্তি করে নিতে হবে। বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রসিদ প্রদানে বাধ্য থাকবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা যায় না। ভাড়াটিয়া প্রয়োজন মনে করলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক থাকবেন। তাদের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে।’

চ্যালেঞ্জে বিদেশি বিনিয়োগ

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ এএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম
চ্যালেঞ্জে বিদেশি বিনিয়োগ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসা উচিত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বর্তমানে আসছে ১ শতাংশেরও নিচে। বিদেশি বিনিয়োগের এই রুগ্ণ দশা নতুন নয়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এফডিআই এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 

বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধির দেখা মিলেছে। অনেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। বরং এফডিআই কমে গেছে।

চলতি বছরের এফডিআইয়ের তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা অন্য দেশের তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৪ শতাংশ কমেছে। 

অন্যদিকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ২০২৩ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পুনঃবিনিয়োগ। বাকিটা নতুন বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে বলছে, ২০২৩ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামে ১৫ বিলিয়ন ডলার। মায়ানমারের মতো গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশেও ৯ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে। 

পার্শ্ববর্তী দেশের এই অগ্রগতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশে কেন বছরের পর বছর ধরে কম এফডিআই আসছে? এর নানাবিধ কারণ রয়েছে এবং এগুলো সবই পুরোনো। এফডিআই কম আসার পেছনের কারণগুলো বিভিন্ন সময়ে শনাক্ত করা হলেও সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে ফলাফল আশানুরূপ নয়। 

বাংলাদেশে কেন এফডিআই কম আসছে তার কারণ ব্যাখা করেন দেশীয় উদ্যোক্তা এবং গবেষকরা। তারা যে কারণগুলো শনাক্ত করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ, জটিল করনীতি ও উচ্চ করহার, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতি, ঠিকমতো ওয়ান স্টপ সেবা চালু না করা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া, ব্যবসার খরচ বেশি হওয়া, বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। তাদের মতে, যতদিন বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না করা হবে ততদিন এ দেশে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। 

অর্থনীতিবিদরা বলেন, বিদেশিরা যদি মনে করেন, অন্য দেশে তাদের জন্য বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক, তাহলে কেন তারা বাংলাদেশকে বেছে নেবেন? অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস। মূলত সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের এই ধারণা কতটা যুক্তিসংগত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রমই কি যথেষ্ট? 

অর্থনীতিবিদরা আরও বলেন, কেবল সস্তা শ্রমের প্রস্তাব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রযুক্তির যুগ। কাজেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করতে পারলে কেবল সস্তা শ্রম দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়, তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অনেক কারণ আছে। এর অন্যতম ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। করনীতির কিছু জায়গা আবার সাংঘর্ষিক। করহার বেশি। দুর্নীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে হচ্ছে না। এগুলো বড় কারণ বলে আমি মনে করি।’ 

তিনি আরও বলেন, অনেক বিনিয়োগকারীকে সেবা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়। বিদেশিরা চান এক জায়গা থেকে সব সেবা পেতে। কিন্তু তারা পান না। ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার সে অনুযায়ী এফডিআইয়ের পরিমাণ কম কেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ এফডিআই আসা উচিত। সে অনুযায়ী বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন এফডিআই আসা উচিত। কিন্তু আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩ বিলিয়ন বা তারও কম। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়া উচিত।’ কিন্তু এর জন্য যে ধরনের পলিসি সাপোর্ট দরকার সেটা নেই বলে মত দেন তিনি। 

শীর্ষ ব্যবসায়ী এই নেতার মতে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া দরকার সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ভালো প্রকল্প বাদ দিয়ে খারাপ প্রকল্পগুলো পিপিপিতে রাখা হয়। এ জন্য পিপিপির উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। 

সূত্র জানায়, ভারত সরকার এফডিআই প্রবাহ বাড়াতে নীতি সংশোধন করেছে। ২০১৫ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ চালু হওয়ার পর থেকে ভারতে এফডিআই প্রবাহ ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

গত সাত বছরে ভারতে এফডিআই প্রবাহ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারতে এফডিআই ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি বেড়ে ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশটিতে এফডিআইয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টা চিত্র দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এফডিআই কমছে। এখন পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি এফডিআই আসেনি। ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে। 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরের মধ্যে (২০১৫ সালে ঘোষিত) সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিন-চারটি দৃশ্যমান হয়েছে। বাকিগুলো কাগজেই রয়ে গেছে। 

গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ব্যবসার খরচ (কস্ট অব ডুইং বিজনেস) অনেক বেশি। নীতিনির্ধারকরা পলিসির যে প্রতিশ্রুতি দেন তা প্রতিপালন হয় না। যেমন: বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চিত হয়নি।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া খুবই জটিল। এখানে বড় ধরনের সংস্কার না করলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। নিরবছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি আছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কথা বলে গেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’

বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি- এ কথা উল্লেখ করে এই গবেষক ও অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এ কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যদি বিনিয়োগসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে এটি নিষ্পত্তি করার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনো বিরোধ হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পান। সর্বোপরি আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। রিজার্ভ কমে গেলে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে ভয় পান। তারা মনে করেন, এমন পরিস্থিতি থাকলে বিনিয়োগ করলে তা থেকে রিটার্ন আসবে না।’

পাঁচ মেগা প্রকল্পে খরচ বেড়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৫০ এএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম
পাঁচ মেগা প্রকল্পে খরচ বেড়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা
ছবি: সংগৃহীত

দেশের রেল ও সড়কপথে যোগাযোগের পাঁচটি মেগা প্রকল্প- পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার-দোহাজারী রেলপথ এবং মেট্রোরেল প্রকল্পে বিপুল অর্থ অপচয়ের খতিয়ান উঠে এসেছে অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাট, দুর্নীতির কারণে এই পাঁচ মেগা প্রকল্প নির্মাণের আগে-পরে ব্যয় বেড়েছে ৫৬ হাজার ৬০৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। 

গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিটির সদস্যরা এ প্রতিবেদন জমা দেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পাঁচ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। হিসাব বলছে, প্রাথমিক ব্যয়ের তুলনায় ২৩৭ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এসব প্রকল্পে। 

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, এই পাঁচ প্রকল্পে কেনাকাটায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) মেনে চলা হয়নি। প্রকল্পের কেনাকাটায় অস্বচ্ছতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগও উঠেছে একাধিকবার। অনেক ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান না করে সরাসরি বরাদ্দ দেওয়ার নজির রয়েছে। এতে করে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় লাগা ও টাকা খরচ হওয়া একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পরিকল্পনা পরিবর্তন এবং সঠিক পূর্বাভাসের অভাবে এই ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। সংশোধিত ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (ডিপিপি) সময় ও ব্যয়ের পরিবর্তনগুলো উল্লেখ থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রকৃত অর্থে এই ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া, অদূরদর্শী নীতি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পগুলোর ব্যয় ক্রমাগত বেড়েছে।

শ্বেতপত্রের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এখন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও সময় বৃদ্ধি এটা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। খুব প্রয়োজন না হলে ব্যয় বৃদ্ধি করা হবে না। আবার বৃদ্ধি হলে সেটা যেন যুক্তিসংগত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। শুধু ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে যে ব্যয় বৃদ্ধি সেটিই করা হচ্ছে। এর বাইরে ভূমি অধিগ্রহণে যে ব্যয় বৃদ্ধি এটাও বিবেচনা করা হচ্ছে।’ 

পদ্মা সেতু ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পে সংশোধনীর প্রভাব রয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরবর্তী সময়ে রেল সংযোগ এবং নতুন সংযোজন হিসেবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রেলপথ যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার-দোহাজারী রেল প্রকল্পে প্রাথমিক ডিজাইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৮৪৭ শতাংশ। 

পদ্মা সেতু প্রকল্পেও একই চিত্র দেখা গেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে অ্যাপ্রোচ রোড (সংযোগ সড়ক) এবং টোলপ্লাজার জন্য বরাদ্দ ছিল ১২৭ কোটি টাকা। এই অর্থ ২০১৫ সালে পুনরায় সংযোজনের মাধ্যমে ২ হাজার ১০৯ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এই অতিরিক্ত ব্যয় কেবল প্রকল্প বাস্তবায়নকে জটিল করেনি, বরং দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। 

বাংলাদেশের বড় নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে ব্যয়ের তুলনায় কাজের মান নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। শ্বেতপত্র কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার লেনের সড়ক নির্মাণে যে ব্যয় হয়, তা ভারতের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ গুণ এবং পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। উদাহরণ হিসেবে রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেন সড়কে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানাবিধ অনিয়মের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে। ভূমির দাম প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাস্তবের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। এতে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। 

শ্বেতপত্র কমিটির দাবি, ভূমি অধিগ্রহণের অতিরিক্ত মূল্যায়নের সুবিধাভোগী একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তাদের কারণে প্রকল্পের ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের উদাহরণ টেনে বলা হয়, প্রকল্পটি বারবার সংশোধনের ফলে ব্যয় প্রাক্কলনের তুলনায় ১২ গুণ বেড়েছে। এই ধরনের সংশোধন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

কমিটি বলছে, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের জন্য নানা নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। কর্ণফুলী নদীর টানেলের নির্মাণ ব্যয় ২০১৫ সালের ডিপিপি থেকে ২০২২ সালের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও আর্থিক বিশ্লেষণের মূল সূচকে (উপকারিতা-ব্যয় অনুপাত এবং অভ্যন্তরীণ রিটার্ন রেট) কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের সময়কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবহন খাতের ৩২৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়েছে। ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রকল্পে সময় বা ব্যয় বেড়েছে। গড়ে প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সময় ৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতা সরকারি বিনিয়োগের প্রত্যাশিত হার কমিয়ে দেয়। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘শ্বেতপত্রে উল্লিখিত অভিযোগগুলো প্রায় প্রমাণিত হয়েছে। আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে প্রকল্পের খরচ অনেক বেশি বলে বেরিয়ে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। কিছু প্রকল্প শেষের পথে। এখন সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে। তারা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে কিছু টাকা পুনরুদ্ধার করতে পারে, যারা এসব অপচয়ের জন্য দায়ী। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পর যদি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া না যায়, তা হলে এটি দেশের জন্য আরও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।’

রাজধানীর অলিগলিতে শীতের পিঠার পসরা

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ এএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম
রাজধানীর অলিগলিতে শীতের পিঠার পসরা
শীতের পিঠা খেতে দোকানে ভিড়। শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে। ছবি: খবরের কাগজ

কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতি আর বাড়ির উঠানে ধোঁয়া ওঠা চুলার পাশে পিঠা তৈরির ব্যস্ততা যেন বাংলার শীতের এক বাস্তব ও অনন্য চিত্র। এই ঋতুতে পিঠা-পুলির আয়োজন বাংলার শীতকে আরও আনন্দমুখর করে তোলে। রাজধানীর কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনে গ্রামবাংলার উঠানে পিঠার ধোঁয়া, সরল আয়োজন এবং পারিবারিক উষ্ণতা হয়তো অনুপস্থিত। তবে শীতের আগমনে পিঠাবঞ্চিত থাকেন না নগরবাসীও। অলিগলি থেকে শুরু করে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ও দোকানে তৈরি হয় হরেক রকমের পিঠা। এসব দোকানে গিয়ে নগরবাসী নেন পিঠার স্বাদ।

শীতের শুরুতেই শহরের রাস্তার ধারে মাটি ও গ্যাসের চুলা নিয়ে বসে যান মৌসুমি পিঠা বিক্রেতারা। এসব দোকানে মেলে চিতই, পাটিসাপটা, পুলি ও ভাপা পিঠা। গরম-গরম ধোঁয়া ওঠা চিতই পিঠার মূল আকর্ষণ নানান হলো পদের ভর্তা। খেজুরের গুড় ও নারকেল দিয়ে তৈরি ভাপাও পাওয়া যায় এসব অস্থায়ী পিঠার দোকানে।

গত কয়েক দিনে মিরপুর, আগারগাঁও, বাংলামোটর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের গলি, ফার্মগেট, কলাবাগান এবং কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তার ধারে, মোড়ে ও ফুটপাতে শীতের পিঠা বিক্রি করতে দেখা গেছে। কর্মব্যস্ত অফিসফেরত মানুষ, শীতের ক্লান্ত বিকেলে বিষণ্নতা কাটাতে ঘুরতে বের হওয়া দম্পতি, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, দিনমজুরসহ সব শ্রেণির মানুষ এসব দোকানের ক্রেতা।

ছুটির দিনে আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনের রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছেন রাশেদ-মৌমিতা দম্পতি। ভ্রাম্যমাণ এক পিঠার দোকানে তাদের দুজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। শীতের পিঠা নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মৌমিতা বলেন, ‘শীতের পিঠার সঙ্গে অনেক পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। শৈশবে মা-দাদুর হাতের পিঠার স্বাদ, গ্রামে শীতকালীন পিঠা উৎসব, সবকিছু মনে পড়ে যখন শীতের পিঠা হাতে নিই। পিঠা ছাড়া শীতের অনুভূতি যেন ঠিকভাবে আসে না। শহরের ব্যস্ত জীবনে ফুটপাতে এমন পিঠার দোকান যেন এক আশীর্বাদ।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন গলিতে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী পিঠার দোকান বসেছে। ওই এলাকা থেকে বাসায় পিঠা নিতে এসেছেন হুমায়ুন ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শীতকালে ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়ার স্বাদ একদম ভিন্ন। আর অন্যান্য ভাজাপোড়া খাবারের চেয়ে এই পিঠা অনেক নিরাপদ। তাই আমি ও আমার বাচ্চাদের জন্যও পিঠা নিতে এখানে এসেছি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখান থেকে পিঠা নিয়ে যাই। গত বছর ৭ টাকা পিস পিঠা কিনতাম, কিন্তু এখন সেই পিঠা কিনতে হচ্ছে ১০ টাকায়।’

পিঠার দোকানি আবুল হাসান বলেন, ‘আটা, লাকড়ি, ভর্তা বানানোর উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় পিঠার দামও বেড়েছে। আগে চিতই বিক্রি করতাম ৭ টাকায়, এখন দাম বাড়ানোর কারণে সাইজ বড় করে এক একটি চিতই ১০ টাকায় বিক্রি করছি। তবে ভাপা এখনো ১০ টাকায় বিক্রি করছি।’

দোকানিরা জানান, চিতই পিঠার মূল আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। চিতই পিঠার জন্য তারা প্রায় ১০ থেকে ১৫ পদের ভর্তা প্রস্তুত করেন। তবে মরিচ, সরিষা, কালোজিরা, ধনেপাতা, শুঁটকি এবং ডালের ভর্তার চাহিদা বেশি। ক্রেতারা পিঠার সঙ্গে বিনামূল্যে চাহিদামতো ভর্তা নিতে পারেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিতই এবং ভাপার পাশাপাশি নারকেল, কলা ও তাল দিয়ে তৈরি পিঠাও কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে। রয়েছে ডিম চিতই, পাটিসাপটা। কিছু দোকানে মাংস দিয়ে বানানো পিঠাও পাওয়া যাচ্ছে। রকমভেদে দামে পার্থক্য রয়েছে। তবে দাম ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে থাকে।

ফার্মগেট এলাকায় নারী পিঠা বিক্রেতা সুরভীর কাছ থেকে চিতই কিনছিলেন শাহানাজ আক্তার। তিনি পিঠা কেনার পাশাপাশি চিতই পিঠা বানানোর কৌশলও জেনে নিচ্ছিলেন। বিক্রেতা বললেন, ‘পিঠার মধ্যে চালের গুঁড়া আর পানির সঠিক পরিমাণ রাখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। এটি সঠিক হলে পিঠাও সুন্দর হবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাওন বিশ্বাস ও রিয়াজুল ইসলাম। ফার্মগেট এলাকায় ছাত্রাবাসে থাকেন। তারা জানালেন, বাড়িতে থাকলে প্রতিদিনই শীতের পিঠা খেতাম। তবে এখন তারা শীতের পিঠার স্বাদ থেকে বঞ্চিত নন। ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম হাঁটলেই পিঠার স্বাদ নিতে পারেন।

এই এলাকায় পিঠা বিক্রি করেন আতিকুর রহমান। তিনি দিনে সাত কেজির মতো চালের গুঁড়া, পরিমাণমতো গুড় ও নারকেল জোগাড় রাখেন। বিকেল ৪টার দিকে শুরু হয় তার পিঠা বিক্রি। রাত ১০টার দিকে উপকরণ শেষ হলে দোকানও বন্ধ করে দেন। তারা দোকানে তিনজন কাজ করেন। প্রত্যেকের প্রতিদিন গড়ে এক হাজার টাকার মতো থাকে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। সামনে বিক্রি আরও বাড়বে বলেও তার প্রত্যাশা।

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });