বাংলাদেশের ১৪তম নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ অক্টোবর ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। কিন্তু ২০২২ সালে করা বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কারের আগেই এই কমিটি গঠন হওয়ায় এবারও ইসিতে যথাযথ ব্যক্তিদের মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
তবে যে আইনেই গঠিত হোক, এবারের সার্চ কমিটি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনের পরও আইনি সংস্কারে কোনো বাধা নেই। তার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কারকাজ একসঙ্গে এগিয়ে নিতে চলমান আইনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়েই গঠিত হবে নতুন নির্বাচন কমিশন।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের আগে কোনো ধরনের আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা অনুসারে তখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হতো। ২০২২ সালের আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে একটি সার্চ কমিটি হলেও তার ফলাফল ছিল ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন কমিশন। পরবর্তী সময়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠিত হয়, সেটিও একটি প্রহসনের নির্বাচন উপহার দেয়। ফলে পুরোনো আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে এবারে কেমন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় এবং তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে কতটা ভালো নির্বাচন উপহার দেয়, তার ওপরেই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।
তারা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ হলো ইসি গঠনের সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ। আর ২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিদ্যমান আইনটি নানা মহলে বিতর্কিত। কারণ আইনটিতে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রস্তাব পাওয়ার আগেই কেন তাড়াহুড়ো করে সার্চ কমিটি গঠন করা হলো তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে। অনেকে বিতর্কিত আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নতুন ইসি কমিশন গঠন হলে নতুন করে বিতর্ক উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা আইনটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশীদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওই আইনে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। সেটি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ আইন-২০২২’ নয়; শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২’। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে পূর্ণাঙ্গ আইন তথা ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২৪’ প্রণয়ন করা জরুরি ছিল। অথচ সেটি না করে ওই আইনেই সার্চ কমিটি করা হলো। এতে নতুন ইসি কমিশনে যথাযথ ব্যক্তির মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেল। নতুন আইন হলে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী ইসির কাজ, সংবিধান নির্দেশিত ক্ষমতার প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের নানা আইনি ও আইনবহির্ভূত রাজনৈতিক বাধা দূর হতো। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিধানাবলি সংযোজন, কমিশনের অর্থায়ন, নিয়োগ, নির্বাচনকালে নিজ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট আইনি বিধান সংযুক্ত করা দরকার ছিল। আর সেটা হলে কমিশন যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তাদের সাহসী সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সক্ষম হতো বলে মনে করি।’
ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থার আইনি সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠনের বিধান করা। যতটুকু জানি সংস্কার কমিশন বিতর্কিত আইনটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব তৈরি করছে। অথচ সেই প্রাথমিক পদক্ষেপে সরকার তাড়াহুড়ো করায় জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আর সংস্কার কমিশন তার রিপোর্ট শেষ করার আগেই পুরোনো আইনে সার্চ কমিটি গঠন হওয়ায় বোঝা গেল এখনো কোনো সংস্কার বাস্তবায়িত হয়নি। এটি সংস্কার কমিশন এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। তারপরও বলতে চাই, যেহেতু সার্চ কমিটি হয়েছে, তাই নির্বাচনি সংস্কার কমিশন যেন একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় করতে সার্চ কমিটিকে সহযোগিতা করে। নতুন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়ায় যেন স্বচ্ছতা থাকে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের মতামতকে যেন প্রাধান্য দেওয়া হয়।’
রাজনৈতিক দলগুলোও চলমান আইনের সমালোচনা করে তা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিল। এই আইন পাসের আগে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও গণফোরামের ১২ জন সংসদ সদস্য ৭৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছিল, যার সবই ছিল মূলত শব্দগত পরিবর্তন। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি।
সার্চ কমিটি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সিইসিসহ কমিশনাররা তো অনেক দিন আগেই পদত্যাগ করেছেন। ফলে সরকার চাইলে এই কমিটি অনেক আগেই করতে পারত। একই সঙ্গে নির্বাচনের অন্যান্য প্রস্তুতিও নেওয়া যেত। দেশের জনগণ নির্বাচন চায়। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এখনো যদি সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে, তাহলে দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। তাই সংস্কার ও নতুন ইসি কমিশন গঠনের পাশাপাশি সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সার্চ কমিটি গঠনকে সরকারের ইতিবাচক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ইসি গঠনে আইনি পুরোনো সব ফাঁকফোকর রয়েই গেল। এখনো যদি বিদ্যমান আইনেই সার্চ কমিটি করা হয়, তাহলে এতসব সংস্কার উদ্যোগের উদ্দেশ্য কী ছিল? এই কমিটি গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তাড়াহুড়ো করে গঠিত এই সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত কমিশন সম্পর্কে জনগণের উদ্বেগ পুরোপুরি সমাধান কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
এদিকে যে আইনেই গঠিত হোক না কেন, এবারের সার্চ কমিটি নিয়ে আশাবাদী সংস্কার কমিশন। কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা অত্যন্ত সম্মানিত এবং সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। আশা করি এই কমিটির সদস্যরা নতুন নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করবেন।’
বর্তমান আইনটি প্রকৃতপক্ষে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি সংস্কারের বিকল্প নেই। সার্চ কমিটি তার নিজস্ব গতিতে কাজ করবে এবং আমরা আমাদের মতো কাজ করব। যে প্রস্তাবগুলো দেব তার কিছু সরকার এবং কিছু নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করবে। তাই সার্চ কমিটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় ওই কমিটি গঠনের পর সংস্কারে কোনো বাধা নেই। সার্চ কমিটি আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে।’
সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। তবে বলতে পারি আইনে বিদ্যমান সব ঘাটতি পূরণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কারে আমাদের লক্ষ্য, অংশীজনদের (রাজনৈতিক দল) কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রস্তাব তৈরি করা।’
আইনি সংস্কারের আগেই কেন সার্চ কমিটি- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘উদ্বেগ সম্পর্কে আমরা অবগত। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কাজ একযোগে এগোবে। যদিও সংস্কারকাজ চলছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও এগিয়ে নিতে হবে। কারণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কাজে সময় বাঁচাতে আমরা সার্চ কমিটি গঠন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় সব রাজনৈতিক দল সময়মতো নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আমরাও সময় বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলমান আইনে গঠিত হলেও এবারের সার্চ কমিটিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সবার পরিচিত, জ্ঞানী এবং নিরপেক্ষ। তাদের লক্ষ্য সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন প্রার্থীদের মনোনীত করা; যারা সবার কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করা।’
গত আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ৯০ দিন আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কমিশনকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে প্রস্তাবিত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। একই মাসে গত ৩১ অক্টোবর, সরকার হঠাৎ করে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর অধীনে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়।
২০২২ সালে করা আইনে প্রথম গঠিত হয় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক মাসের মাথায় শিক্ষার্থী-জনতার চাপের মুখে ৫ সেপ্টেম্বর বিদায় নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন, যাদের অধীনে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল।