জরিমানা বাড়িয়ে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ই-সিগারেট, ভ্যাপার ও হিটেড টোব্যাকোসহ কয়েকটি তামাকজাত দ্রব্য সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কয়েকটি ধারায় জেল-জরিমানা আড়াই গুণ থেকে সাড়ে ৬ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫’ অধিকতর সংশোধনের জন্য ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন-২০২৩’ বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন হতে পারে বলে জানা গেছে।
প্রস্তাবিত সংশোধনের খসড়ায় আইন লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা ২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে অনধিক ৫ লাখ টাকার বিধান রাখা হয়েছে। সংশোধনীতে নতুন ধারা ৬(ছ) যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মসলা, সুগন্ধি (ফ্লেভার), আসক্তিমূলক দ্রব্য, রং ইত্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে এসব উপাদানসহ অন্য কোনো মিশ্রণ যুক্ত করতে পারবেন না বা করাতে পারবেন না। কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার বা বারবার একই ধরনের অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিক দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন।
৬(ঙ) ধারায় ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টস ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ও ই-লিক্যুইড ইত্যাদি), হিটেক টোব্যাকো প্রডাক্টস বা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন- উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করতে পারবেন না। হিটেড টোব্যাকোর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এটি এমন তামাকজাত দ্রব্য, যা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন করে এবং ব্যবহারকারী যা শ্বাসের মাধ্যমে মুখে টেনে গ্রহণ করে। এই ধারায় অপরাধ প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কোম্পানির মালামাল জব্দসহ দায়ীদের কমপক্ষে ৬ মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন এবং কোম্পানির ক্ষেত্রে উৎপাদন ও বিক্রয়ের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশুপার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সময়ে সময়ে আদেশ দিয়ে সীমানার পরিধি বাড়াতে পারবে। এই বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ও দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হারে দণ্ড দেওয়া হবে। সরকারের নিবন্ধন ছাড়া কেউ তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না। এই বিধান লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ও দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিক দ্বিগুণ হারে দণ্ড দেওয়া হবে।
নিষিদ্ধ কুম্ভি পাতা, টেন্ডু পাতা বা অন্য কোনো গাছের পাতা দ্বারা মোড়ানো বিড়ি উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও কেনাবেচা করলে সর্বোচ্চ ৩ মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিক দ্বিগুণ হারে দণ্ড দেওয়া হবে। কোম্পানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাতিল, আর্থিক লেনদেন স্থগিত বা জব্দসহ আর্থিক জরিমানা আরোপ করা যাবে। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে কুম্ভি পাতা, টেন্ডু পাতা বা অন্য কোনো গাছের পাতা দ্বারা মোড়ানো বিড়ি শুধু ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কাগজে মোড়ানো প্রচলিত বিড়ি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।
সংশোধনীতে তামাকজাত দ্রব্যের সব মোড়ক, কার্টন, বস্তা ও কৌটার উভয় পাশে মূল প্রদর্শনী তল বা যেসব প্যাকেটে দুটি প্রধান পার্শ্বদেশ নেই সেই সব প্যাকেটের মূল প্রদর্শনী তলের ওপরে কমপক্ষে ৯০ ভাগ স্থানে বাংলায় তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতি সম্পর্কে সতর্কবাণী ও উৎপাদনের তারিখ লিখতে হবে। এ বিধান লঙ্ঘনের দায়ে কোম্পানির মালামাল জব্দসহ কোম্পানির মালিক ও দায়ীদের সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হারে দণ্ড এবং কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং ছাড়া তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের নতুন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘তামাক’ বলতে কোনো নিকোটিয়ানা টাবাকাম বা নিকোটিয়ানা রাসটিকার শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদ বা এ-সম্পর্কিত অন্য কোনো উদ্ভিদ বা এসব উদ্ভিদের কোনো পাতা বা ফল, শিকড়, ডাল বা তার কোনো অংশ বোঝাবে। ‘তামাকজাত দ্রব্য’ বলতে তামাক, তামাক পাতা বা এটার নির্যাস হতে প্রস্তুত করা যেকোনো দ্রব্য, যা চুষে বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাস দিয়ে টেনে নেওয়া যায় বা অন্য কোনোভাবে সেবন করা যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগার, হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণ এবং নতুন তামাকজাত দ্রব্য যেমন ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, হিটেড টোব্যাকো দ্রব্য ইত্যাদি নিকোটিন দ্রব্য। এসব যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এসব তামাকজাত দ্রব্য হিসেবে এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিদ্যমান আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি ৩০০ টাকা জরিমানা থাকলেও তা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হারে বাড়বে দণ্ড।
বিদ্যমান আইনে টিভি, সংবাদপত্র, বিলবোর্ডের মাধ্যমে প্রচার নিষিদ্ধ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটেও প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইন্টারনেট বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬-এর ধারা ২-এর দফা (৮)-এ প্রদত্ত সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী ইন্টারনেটকে বোঝানো হয়েছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে কোনো তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক ও প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। কোনো বাণিজ্যিক গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে অথবা কোনো অনুষ্ঠান বা কর্মসূচির নামে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে না। এই বিধান লঙ্ঘনে ১ লাখ টাকা জরিমানার পরিবর্তে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে অভিযোগ দায়ের ও মামলা নিষ্পত্তিসহ সব ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।