আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও চাঁদপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নির্বাচনি এলাকায় সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত নির্দিষ্ট দুটি বাহিনী। একটি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত মতলব উত্তর উপজেলা এবং আরেক বাহিনীর হাতে ছিল মতলব দক্ষিণ। সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন, মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন, মাদক ব্যবসা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার কাজগুলো তাদের মাধ্যমে হয়ে আসছিল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মায়া চৌধুরীসহ তার বাহিনীর লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন এখনো বন্ধ হচ্ছে না।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মায়ার দুটি বাহিনী আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। মতলব উত্তর উপজেলার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কুত্তা মামুন, রিয়াদ, রিয়াজুল ইসলাম, শরীফ ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার শুভা। দক্ষিণে বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মেয়র আওলাদ হোসেন লিটন, উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শওকত আলী বাদল এবং জেলা পরিষদ সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা আল-আমিন ফরাজি।
সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন-বাণিজ্য
মতলব উত্তর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন বেড়িবাঁধ নিয়ন্ত্রণে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক নির্মাণকাজ থেকে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন ১০ শতাংশ কমিশন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এই কমিশন-বাণিজ্য শুরু করেন বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় ঠিকাদার আলাউদ্দিন সরকার, বাতেন চেয়ারম্যান এবং লধুয়া গ্রামের রিপন পাটওয়ারী যৌথভাবে এই কাজের ঠিকাদার ছিলেন। তাদের কাজ আটকে দিয়ে তিনি এই টাকা নিয়ে নেন।
স্থানীয় সরকারের অধীন দুই উপজেলার সরকারি গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। সেখান থেকে কাজের ধরন হিসেবে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত তিনি এই কমিশন আদায় করেন।
মতলব উত্তরে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে মায়া চৌধুরী ৩ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এটির নির্মাণকাজ এখনো চলমান। তবে এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীসহ কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ৫ আগস্টের পর এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী নামফলক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন ভেঙে ফেলেছেন।
ঠিকাদার আলাউদ্দিন সরকার জানান, তিনি ব্লকের কাজ করেছেন সংস্কারমূলক। তার কাজ ছিল ছোট। তাকে এমপির লোকজন তেমন বিরক্ত করেননি। তবে মতলব দক্ষিণের আওয়ামী লীগ সভাপতি এইচ এম কবিরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছেন। এইচ এম কবির বলেন, ‘আমি সরাসরি কাজ করিনি। আমার ছোট ভাইসহ কয়েকজন ব্লকের কাজের ঠিকাদার।’ এমপির লোকজন কমিশন নিয়েছেন সরাসরি স্বীকার না করলেও তিনি বলেন, কাজ করলে লাভ-লোকসান হবেই।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কমিশন-বাণিজ্য
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন এবং সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রত্যেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই কাজে যুক্ত ছিলেন তার ছেলে দীপু চৌধুরী। ২০১৪ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রত্যেক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে মনোনয়ন দেওয়া বাবদ নিয়েছেন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছেন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক প্রার্থী বলেন, মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়া এবং নির্বাচনে বিজয়ী করার চুক্তিতে এই টাকা নিতেন।
মতলব উত্তরের মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফিজ মাস্টারের কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন ২ কোটি টাকা। সাংবাদিক পরিচয়ে এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি ওই ইউনিয়নে উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন বলে জানান। তবে তিনি যে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন সে ব্যাপারে সত্যতা জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনি আমার সামনে আসেন তখন বলব।’ এই বলে ফোন কেটে দেন।
এ ছাড়া সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে মতলব উত্তর উপজেলার গজরার ইউনিয়নের মফিজুল ইসলাম, বাগান বাড়ির নান্টু মিয়া, সাদুল্যাপুরের লোকমান মুন্সী, কলাকান্দার ছোবহান সরকার শোভা, ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের আজমল চৌধুরী, ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের দেলোয়ার সরকারসহ অনেকের কাছ থেকে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।
মতলব দক্ষিণ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এইচ এম কবির বলেন, ‘সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মায়া চৌধুরী আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সমর্থন করেননি। বরং উল্টো তার লোকজন দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আমি যাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি সেই সিরাজুল মোস্তফা তালুকদারকে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন।’
একই উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী রিপন মির বলেন, ‘আমি কখনো টাকা দিয়ে নৌকার মনোনয়ন পাইনি। দল থেকেই আমাকে দিয়েছে। তবে আমাদের ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন টাকা দিয়ে নৌকার প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন।’
মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মায়া চৌধুরী ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। ওই সময় তার ছেলে দীপু চৌধুরী, স্ত্রীসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে ড্রেজার দিয়ে মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন হয়েছে। প্রতিদিন বালু তোলা হতো ২০ লাখ ঘনফুট। এলাকাভিত্তিক এই কাজ করতেন তার আত্মীয় আহার খালাসি, বোরহান খালাসি ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার শুভা। আর স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বালু মিজান, সাবেক মেয়র রফিকুল ইসলাম জজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর মাস্টার।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারির পর আবারও বালু উত্তোলনের কাজটি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কারণ ২০১৮ সালে এই আসনের সংসদ সদস্য পদ হারান মায়া চৌধুরী। এই আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল।
এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মৃধা বলেন, মায়া চৌধুরী যতবারই এমপি এবং মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে জড়িত ছিলেন। তার প্রভাবের কারণে কেউ মুখ খুলতে পারেনি। আর বালু উত্তোলনকাজের মূল হোতা ছিলেন আহাদ খালাসি, বোরহান খালাসি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর ও পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘মায়া চৌধুরী প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন। তার মতের বিরুদ্ধে কিংবা কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা যায়নি। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, মামলা ও হামলা করেছেন। মামলা দিয়ে শত শত লোককে এলাকা ছাড়া করেছেন। তার লোকজন বহু মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছেন। তার অত্যাচারের কারণে পাঁচ মাস বিভিন্ন জায়গায় থেকে ৫ আগস্টের পর বাড়িতে এসেছি।’
উন্নয়নমূলক কাজ ও বদলি-বাণিজ্য
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন ব্যক্তিগত সহকারী বেলাল ও মতলব উত্তর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর এবং মেয়র রফিকুল ইসলাম জজ। তারা সারা দেশে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নির্মাণ করা ব্রিজের কমিশন উত্তোলন করতেন। প্রত্যেক ব্রিজ থেকে নেওয়া হতো ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন। আর সারা দেশে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বেলাল। এই কাজে যুক্ত ছিলেন মায়া চৌধুরীর প্রয়াত ছেলে দীপু চৌধুরী।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মায়া চৌধুরীর নির্বাচনি এলাকার একাধিক সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘তিনি আমাদের দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের মধ্যে বিভাজন করেছেন। অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে দমন করেছেন। হুমকি-ধমকি দিয়ে সাংগঠনিক কাজগুলো থামিয়ে দিয়েছেন।
মায়া চৌধুরীর নিজ ইউনিয়ন মোহনপুর। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন তার চাচাতো ভাই বাবুল চৌধুরী। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০২৩ সালে উপনির্বাচন হয়। সেখানে নৌকা প্রতীক পান কাজী মিজানুর রহমান। তিনি মায়া চৌধুরীর মতের বিরুদ্ধের লোক হওয়ায় তার নৌকা বাদ করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইকে নৌকা এনে দেন। এরপর শুরু হয় কাজী মিজানের বিরুদ্ধে অত্যাচার, হামলা ও মামলা।
কাজী মিজান বলেন, ‘মায়া চৌধুরী তার লোক দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা দিয়েছেন। এলাকায় লুটপাট করেছেন। বেশ কয়েকটি মামলা দিয়ে লোকজনকে বাড়ি ছাড়া করেছেন। আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্র ভেঙে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে তার লোকজন। আমার ২০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। এ বিষয়গুলো প্রশাসন, পুলিশ ও চাঁদপুরবাসী জানে। এসব ঘটনায় আমি তার লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা দিয়েছি। মামলাগুলো চলমান।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মায়া চৌধুরীর মোহনপুর ছাড়াও কানাডা, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে বাড়ি আছে। তিনি গত ৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ওই দিন রাতে আর ঢাকায় ফেরেননি। পরদিন ৪ আগস্টও বাড়িতে ছিলেন। সারা দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঢাকায় যাননি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু উপজেলা থেকে বের হতে পারেননি। পরে নিজের গাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়ে অন্য গাড়ি করে কুমিল্লা হয়ে ভারতে চলে যান।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতলব উত্তর উপজেলার বাসিন্দা তানভীর হুদা বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-মতলব দক্ষিণ) নির্বাচনি এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা বহু মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন। মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের বাড়ি ছাড়া করা হয়েছে। মায়া চৌধুরীর লোকজন আমার ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করেছে একাধিকবার। আমি নিজেই বারবার তাদের হামলার শিকার হয়েছি।’
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর দুই উপজেলায় তার বাহিনীর লোকজন সরকার পতনের পর আত্মগোপনে আছেন।