‘নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ’ প্রকল্পের নকশা তৈরি করতে খরচ ধরা হয়েছিল ১০ লাখ টাকা, স্টেশনারি খাতে ১০ লাখ ও স্থাপত্য নকশা ছাপানোর জন্য ১০ লাখ টাকা। কিন্তু পাঁচ বছরে এসব খাতে এক পয়সাও খরচ হয়নি। অন্যান্য খাতেও বেশি করে খরচ ধরা হয়েছিল। কিন্তু তেমন খরচ হয়নি। বাধ্য হয়ে প্রকল্পটি সংশোধন করে দুই বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। তাতে মোট খরচ কমানো হলেও কিন্তু আগামী দুই বছরে এসব খাতে বেশি করে খরচ ধরা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হলে এসব ধরা পড়ে। সভায় বিভিন্ন খাতে অযৌক্তিক খরচ ধরা হয়েছে বলে আপত্তি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা অধিদপ্তর। সার্বিক ব্যাপারে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব মোকতার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে গত দুই দিনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সাড়া না দেওয়ায় তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮৩ শতাংশ। মাটি ভরাট, সাবস্টেশন নির্মাণসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তাই সংশোধন করা হচ্ছে। সময় বাড়ানো হচ্ছে দুই বছর। এসব কাজে দুই বছর লাগবে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে মাটি ভরাটের কাজ থমকে যায়। প্রশাসনিক ভবনের কাজও ৫০ শতাংশ বাকি রয়েছে। এসব কাজ করতে দুই বছর সময় লাগবে।’
পরিকল্পনা কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদী কারাগার প্রথম চালু হয় ১৯৮৩ সালে (মহকুমা কারাগার হিসেবে); যা ১৯৮৮ সালে জেলা কারাগার হিসেবে উন্নীত হয়। আশির দশকে দেশের সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন ছাড়াই গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সাব-জেলকে জেলা কারাগার হিসেবে উন্নীত করা হয়। জেলা কারাগার হিসেবে ঘোষণার সময় এখানকার অনুমোদিত ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ২৪৪ জন। নরসিংদীকে জেলায় উন্নীত করার পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে জেলা কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এই কারাগারে গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজার জন বন্দি অবস্থান করছেন। ধারণক্ষমতার চার গুণ বেশি বন্দি কারাগারে থাকছেন।
খালি জায়গা না থাকায় বন্দিদের জন্য ব্যারাক নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে কারা অধিদপ্তর রাজস্ব বাজেট থেকে ৬০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকা-নরসিংদী মহাসড়কের পাশে ২০ একর বা ৬০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। যেখানে নতুন কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করে কারা অধিদপ্তর। আটক বন্দিদের বসবাসের সুষ্ঠু পরিবেশ দেওয়ার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়।
তারই অংশ হিসেবে নরসিংদী সদরে ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সরকার কারাগার নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, এ প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছিল ৩২৭ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু সে সময়ে কাজের কাজ কিছু হয়নি। পরে খরচ না বাড়িয়ে সময় বাড়ানো হয় দুই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও কাজের অগ্রগতি হয়নি। গত মার্চ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৬৫ শতাংশ।
তাই বাকি কাজ শেষ করতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে। অনেক খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি। তাই খরচ কমানো হচ্ছে ২৮ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ অর্থাৎ মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু সময় বাড়ানো হচ্ছে দুই বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে শেষ হবে আধুনিক জেলখানার নির্মাণকাজ। তা যাচাই করতে গত ৮ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টার নির্দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক প্রকল্প পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত দেওয়া হয়েছে। তার পরও এ প্রকল্পটিতে অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক খরচ ধরা হয়েছে। সভায় জানানো হয়, মোটরযান খাতে ৭ লাখ টাকার বেশি খরচ ধরা হয়েছে। কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছরে এ খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি।
এ ছাড়া যানবাহনের জ্বালানি খাত ও গ্যাসের জন্য অনেক টাকা রাখা হলেও তা খরচ হয়নি। তার পরও এই দুই খাতে আগামী দুই বছরের জন্য ১২ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। মোটরযান রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৪৫ লাখ টাকা রাখা হলেও ২৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের নকশা প্রস্তুত, স্টেশনারি, স্থাপত্য নকশা প্রস্তুত ও ছাপানো খাতেও ১০ লাখ করে ৩০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। যেখানে দীর্ঘ সময়ে এসব খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি।
এ ছাড়া ভ্রমণ খাতে ১২ লাখ টাকা, মনোহারী খাতে ২৪ লাখ টাকা রাখা হলেও তেমন খরচ হয়নি। আসবাবপত্র খাতে আগে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ ধরা হলেও সংশোধনীতে বাড়িয়ে ২ কোটি ৭ লাখ, বনায়ন খাতে ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪০ লাখ, বহিঃবিদ্যুতায়নে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি করে খরচ ধরা হয়েছে। এসব খরচ অযৌক্তিকভাবে ধরা হয়েছে। খরচ যৌক্তিক করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে। এসব সংশোধন করে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে বাকি কাজ শেষ করে সংশোধনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানায়।
প্রকল্পের প্রধান যেসব কাজ ধরা হয়েছে, সেগুলো হলো ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৯ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন, পুরুষ বন্দিদের জন্য দুটি ছয়তলা ভবনের ব্যারাক নির্মাণ, সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য একটি ছয়তলা ভবনের বন্দিশালা নির্মাণ, পুরুষ বন্দিদের জন্য একটি চারতলা ভবনের ব্যারাক, একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত বন্দিদের জন্য একটি দোতলা ভবনের ব্যারাক নির্মাণ। সেই সঙ্গে কারাগারটিতে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত নারী বন্দিদের জন্য একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ ও একটি দোতলা ভবনের সেল নির্মাণ। নারী শ্রেণিপ্রাপ্ত ও কিশোরী বন্দিদের জন্য একটি চারতলা ভবন নির্মাণ, স্বজনদের সঙ্গে বন্দিদের দেখা করার জন্য একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।
অন্যদিকে কারাগারের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় একটি তিনতলা ভবন, ব্যাচেলর অফিসার্সদের জন্য একটি তিনতলা ভবন, ১ হাজার ২৫০ বর্গফুট, ১ হাজার বর্গফুট ও ৮০০ বর্গফুট আয়তনের একটি করে পাঁচতলা কোয়ার্টার এবং ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ১০ তলার দুটি আবাসিক কোয়ার্টার নির্মাণের ব্যবস্থা থাকবে। বন্দিদের দেখতে আসা দর্শনার্থীদের অপেক্ষা করার ঘর নির্মাণসহ আরও বেশ কিছু কাজ করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, নতুন এ কারাগারে থাকবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। যার মাধ্যমে কারাবন্দিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্দিদের গতিবিধি, কারাগারের ভেতর ও বাইরে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এখন যে কারাগার রয়েছে, সেখানে কারারক্ষীদের জন্য তেমন আবাসনব্যবস্থা নেই। নরসিংদী জেলার নতুন এ কারাগারটি হলে বন্দির ধারণক্ষমতা বাড়বে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পালিয়ে যান এর কয়েদিরা। তার পর থেকেই বেশি আলোচনায় আসে কখন হবে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার আধুনিক এই কারাগার।