চিহ্নিত অপরাধীদের গতিবিধি নজরদারি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত সাদাপোশাকে গোয়েন্দা নিযুক্ত করে থাকে। এবার সীমান্ত এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাই উল্টো অপরাধী চক্রের নজরদারিতে।
সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র্যাবের গতিবিধি নজরদারি (রেকি) করে মাদকসহ নানা ধরনের পণ্য দেদার চোরাচালান হচ্ছে। ‘রেকি’ তৎপরতা চালিয়ে পাচারের ‘রুট ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়া হয়, তারপর শুরু হয় চোরাচালান। এ যেন গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি।
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা বলেছেন, পাচারের রুট ও বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের আনাগোনার তথ্য জানাতে এসব দায়িত্বের জন্য চক্রগুলো নিজেরা ‘বেতনভুক্ত’ বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করে থাকে। মায়ানমারসংলগ্ন কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ-উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ ভারতসংলগ্ন বেশ কিছু সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের অভিনব তৎপরতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিবির মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্তে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি নিয়মিত যৌথ টহল ও অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপতৎপরতার খবর পেলেই বিজিবি অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।’
যেসব কৌশলে ঢুকছে মাদকসহ চোরাই পণ্য
মায়ানমার সীমান্তে চোরাচালান চক্রের এক বা একাধিক সদস্য রুট পাহারা দিয়ে খোদ বিজিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের ওপর নজরদারি করে থাকে। সেই সদস্য চোরাচালানের পণ্য বহনকারী আরেক চক্রকে যখন ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয় বা রুটটি নিরাপদ বলে জানায়, তখনই সেই চালানটি নিয়ে চক্র অগ্রসর হয়। মাদক কারবারিরা মায়ানমার সীমান্তে কক্সবাজারের নাফ নদী এবং ভারত সীমান্তে রাজশাহীর পদ্মা নদী এলাকায় আরও কিছু অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে থাকে।
প্রশিক্ষিত সাঁতারু রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচার চক্রে অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে অন্যতম আরেকটি কৌশল হচ্ছে ককশিটের ভেতরে মাছের আড়ালে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন ঢুকিয়ে ভেলার মতো ভাসিয়ে সীমান্ত পার করা। এই প্রক্রিয়ায় বহনকারী হিসেবে সাধারণত কিশোর বয়সীদের ব্যবহার হয়। এটি ভারত সীমান্তসংলগ্ন পদ্মা নদীতে বেশি হয়। এমনকি ওই সব এলাকায় এক ধরনের ‘চুঙ্গা’ (অতি সরু ভাসমান বাহন) ব্যবহার হয়, যার ভেতরে মাদকসহ মূল্যবান চোরাই পণ্য নিয়ে সীমান্তের এপারে আনা হয়।
সীমান্তের যেসব এলাকায় চক্রের তৎপরতা বেশি
মায়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাকারবারিদের অপতৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছেন টেকনাফের স্থানীয় সামাজিক একটি সংগঠনের নেতৃত্ব স্থানীয় এক ব্যক্তি। যার অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। খবরের কাগজের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপকালে নির্ভরযোগ্য ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্ত এলাকার মাদক-চোরাকারবারিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিরাও প্রকাশ্যে চালাচ্ছে তাদের কারবার। বিশেষ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, খারাইঙ্গাঘোনা, কোণাপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কানজরপাড়া, নয়াবাজার, খারাংখালী, হ্নীলা, সাইটপাড়া, ওয়াব্রাং, এইচকে আনোয়ার প্রজেক্ট এলাকায় চোরাকারবারিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মায়ানমার থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মূলত ইয়াবা, আইসসহ অন্যান্য মাদক ও অস্ত্র আসে বাংলাদেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য পাচার হয়ে থাকে মায়ানমারে, যার মধ্যে তেল, মরিচ, সার অন্যতম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা যা বলছেন
বিজিবির উপমহাপরিচালক (মিডিয়া উইং) ও মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন ছাড়াও সীমান্তে বাড়তি নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। এর ফলে মাদকসহ নানা ধরনের চোরাচালানসামগ্রী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্ধার করা হচ্ছে। এর মধ্যে মায়ানমারের সীমান্ত এলাকাগুলোতে সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে।’
একই প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় আমরা সাধারণত যৌথ অভিযান পরিচালনা করি। সীমান্ত এলাকার মূল দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি। আমরা বিজিবির সঙ্গে যৌথভাবে কিংবা কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবগত করে মাদকসহ চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই।’ চোরাচালান চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নজরদারি করার জন্য সাদাপোশাকে নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করে রেখেছে বলে খবর রয়েছে। এ সম্পর্কে কী জানেন জিজ্ঞাসা করলে মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘এ রকম খবর আমরাও পেয়েছি। আমরা সার্বিকভাবে অবগত হয়েই মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি।’
পরিসংখ্যান যা বলছে
বিজিবির সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, গত অক্টোবর মাসে তাদের অভিযানে সীমান্ত এলাকা থেকে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া বিজিবি গত ১ মাসে ৩ কেজি ১৯৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ১১ কেজি ৮০২ গ্রাম হেরোইন, ২৬ হাজার ৫৯৯ বোতল ফেনসিডিল, ২১ হাজার ৬০৫ বোতল বিদেশি মদসহ বিপুল পরিমাণ মাদকজাতীয় পণ্য উদ্ধার করেছে।
সর্বশেষ শুক্রবার (৮ নভেম্বর) ফেনীর সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য আটক করা হয়েছে, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে।
এদিকে মাদকবিরোধী অভিযানে অন্যতম ভূমিকা রাখা র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩ মাসে (৫ আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর) কেবল র্যাবের অভিযানে মোট ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া একই সময়ে ২১ কেজি ৫৪ গ্রাম হেরোইন, ৪ হাজার ৭৯০ কেজি গাঁজা এবং ৪৪ হাজার ৮৩৬ পিস ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মাদক জব্দের পাশাপাশি মাদকসংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯০১ জনকে।