ঢাকা ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
English
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ফাইল ফটো

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে প্রায় ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে নিরাপত্তাক্ষেত্রে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক)। সম্প্রতি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এভসেকের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় এভসেকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে এপিবিএন। এতে সরকারি এ দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেছেন, পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সক্ষমতা বাড়লে সেখানে কর্মরত অন্য বাহিনীর সদস্যরা চলে যাবেন। 

গত ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা জিডিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এরিয়ার (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা হয়, লোড-আনলোড করা হয়, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।’

জিডিতে বলা হয়, ‘পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে না জানিয়ে কেন মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখলেন- এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনবোর্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, এরই মধ্যে অ্যাপ্রোন এলাকায় থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। তবে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে বিমানবন্দরে কর্মরতদের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘনিয়ে এলে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও দায়িত্ব রেখে পালিয়ে যান। ফলে ওই সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং শঙ্কা তৈরি হয়। পরে এভসেকের সদস্য বাড়িয়ে তাদের দিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সব কাজ করানো হয়। 

অন্যদিকে বন্দরের অন্য আরেকটি পক্ষের অভিযোগ, এভসেকের বাধায় এখন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এপিবিএন। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

তবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান নিরাপত্তার জন্য যেমন শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, ‘দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনো সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন দেখি না।’

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি দুটি সংস্থার এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে। আমরা চাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ আমি শুনেছি ৫ আগস্টের সময় দায়িত্ব নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল; তবে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করে এখন দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ এখানে প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।’

জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমানবাহিনী থেকে ৫০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় এক হাজার জনের নিয়োগের মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। 

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সংস্থাটি। 

এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সক্ষমতার দিক থেকে আমরা আগে যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কেন দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এটি বোঝা যাচ্ছে না। অ্যাপ্রোন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা সরিয়ে ফেলেছে।’

এদিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এভসেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এপিবিএনের জিডির তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাই তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে পুলিশ অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখানে বিমানবাহিনীর সদস্যদের এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারাই ডিউটি করে যাচ্ছেন। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপিবিএন দায়িত্বে ফিরে এসেছে। আমাদের তিন কিলোমিটারব্যাপী এয়ারপোর্টের এরিয়া, যা সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। বহিরাঙ্গনের যে নিরাপত্তা সেটির কাজ এপিবিএন করে যাচ্ছে।’

এপিবিএনকে আবার পুরোনো দায়িত্বে ফেরানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সংস্থাই তো ভেতরে ডিউটি করতে চায়, সবাইকে তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এভিয়েশন সিকিউরিটিকে আরও শক্তিশালী করা। আমাদের সক্ষমতা বাড়লে বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনসহ অন্য কোনো বাহিনীই থাকবে না। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আমরা আরও সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দিতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো সিকিউরিটি কাজ করবে। একসময় এভিয়েশন সিকিউরিটি পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যরা চলে যাবে।’

দোহাজারী-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প: পরিকল্পনাতেই ব্যাপক গলদ

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০০ পিএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৩ পিএম
দোহাজারী-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প: পরিকল্পনাতেই ব্যাপক গলদ

কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনটি পঞ্চম তলা নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনায় গলদ রয়ে গেছে। দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন শেষ পর্যায়ে সংশোধন করে বাদ দেওয়া হয়েছে এই অংশকে। এই হচ্ছে ‘দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ’ মেগা প্রকল্পের বাস্তব চিত্র। 

প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তার পরও ১৭টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশনের নির্মাণকাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। এসব স্টেশন ও সার্ভিস এরিয়া ভবনে নিম্নমানের টাইলস, কাঠ, গ্রিল, কমোড, বেসিন ব্যবহার করা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

পরিকল্পনা ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্য ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মতো দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ বার সংশোধনের মাধ্যমে গত ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হলেও শেষ হয়নি। এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনায় আরও ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত প্রসারিত করার কথা ছিল। কিন্তু মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের এমওইউ করা হয়নি। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এই অংশের কাজ বাতিল করা হয়েছে।

আইএমইডির সচিব মো. আবুল কাশেম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্প পরিদর্শন করার সময় সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করি। এটা আমাদের কাজ। সতর্কতার সঙ্গে টাকা খরচ না করলে প্রকল্পে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। এই প্রকল্পে তেমন কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি। তবে অনেক অডিট আপত্তি ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনে তা আছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় এসবের জবাব দেবে। লক্ষ্য থাকবে যাতে নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটে।’ 

পরিদর্শনকারী (আইএমইডির) পরিচালক ও উপসচিব মো. মুমিতুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন পঞ্চম তলা নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনায় গলদ রয়ে গেছে। কারণ দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। তাই ট্রেন চলাচল করলেও এই স্টেশনের ওপরের ফ্লোরগুলো খালি পড়ে আছে। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন শেষ পর্যায়ে এই অংশকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যখন এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ সেখানে কোনো ব্যবসার উৎস ছিল না। তার পরও ঘুমধুম পর্যন্ত বাড়িয়ে বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে। আমরা অর্থনীতির শ্বেতপত্রে এ ধরনের অর্থ তছরুপের কথা বলেছি। পাঁচতলা কক্সবাজার রেলস্টেশনটি কর্ণফুলী টানেলে বিলাসী হোটেলের মতো অবস্থা। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বিলাসী ভ্রমণের জন্যই এটা করেছেন। এ ধরনের অপরিকল্পিত পরিকল্পনায় যারা জড়িত তাদের ধরা দরকার। কারণ জনগণের করের টাকা ও ঋণ করে এই প্রকল্প করা হয়েছে।’

প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, ‘গত ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টুকটাক কিছু কাজ বাকি আছে। বড় কোনো কাজ বাকি নেই। নভেম্বর পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। যে কাজ বাকি আছে, তা ডিফেক্ট ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে শেষ হবে। এ জন্য এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।’

দেশের অন্যতম পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেললাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সাবেক সরকার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে ২০১০ সালের ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় তৎকালীন সরকার। খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং বিদেশি ঋণ হিসেবে ধরা হয়েছিল ৮১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ডুয়েল গেজ লাইন করার জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ হিসেবে ধরা হয়। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

প্রকল্পের প্রধান কাজ ধরা হয় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ। এ জন্য ৩৯টি মেজর ব্রিজ, ২৩০টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ এবং দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ, রামু উপজেলাসহ ৯টি স্থানে নতুন করে স্টেশন নির্মাণ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ১ হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণের কথাও উল্লেখ করা হয় প্রকল্পে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মতো এটিকেও এর আওতাভুক্ত করেন এবং গভীরভাবে মনিটর করার নির্দেশ দেন। তার পরও ঠিকমতো কাজে গতি আসেনি। ২০২২ সালের ৬ জুন চতুর্থবারের মতো সংশোধন করে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপে দোহাজারী-কক্সবাজারের ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

গত ১১ ও ১২ অক্টোবর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করার পর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পটি আসলে ৩০ জুনে শেষ হবে কি না তা দেখার জন্য আইএমইডির মহাপরিচালক গত ১৭ মে পর্যবেক্ষণ (মনিটরিং) করেন। তিনি অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করাসহ সার্বিক দিক পরিদর্শন করে এক বছর সময় অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন। সেটা আমলে নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক বছর সময় বাড়ানোর সুপারিশ করে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াল ১২ বছর। তবে বাতিল করা হয়েছে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ। এতে ৩৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ এবং উখিয়া ও ঘুমধুম স্টেশন নির্মাণ, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস-ওভারপাসসহ অন্যান্য কাজও বাতিল করা হয়েছে। এসব কাজের জন্য ৬ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার বরাদ্দও বাদ গেছে। এসব বাদ দিয়ে প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং সরকারি খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, লট-১-এর আওতায় নতুন করে বৃক্ষরোপণসহ আগে যেসব বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে সেসবের সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগকে লাভজনক করতে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া আইকনিক রেলস্টেশনসহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপনা প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি।

সিন্ডিকেটের গোড়ায় মাহমুদুল খাদ্য অধিদপ্তরে দরপত্র ছাড়াই খাদ্য পরিবহন

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৯ পিএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
খাদ্য অধিদপ্তরে দরপত্র ছাড়াই খাদ্য পরিবহন
খাদ্য অধিদপ্তরের মাফিয়াখ্যাত চট্টগ্রাম যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক

চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকারি খাদ্য পরিবহনে দরপত্র ছাড়াই কাজ পেতেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ঠিকাদাররা। বিগত সরকারের আমলে আট বছর ধরে চলেছে এই অনিয়ম। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না হওয়ায় সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব হারিয়েছে, অন্যদিকে খাদ্য পরিবহনে গড়ে ওঠা ঠিকাদার সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের গোড়ায় রয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের মাফিয়া ও যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক। 

একাধিক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেছেন, মামলার ফাঁদে ফেলে সিন্ডিকেটটি লুটেপুটে খেয়েছে। মামলার কারণে দরপত্র আহবান করা যায়নি এ কথা সত্য। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জোরালোভাবে মামলা মোকাবিলা করতে চরম অনীহা রয়েছে। যদিও ঠিকাদারি অব্যাহত রাখতে প্রতি তিন মাস অন্তর আঞ্চলিক খাদ্য অধিদপ্তর থেকে দরপত্র রিনিউ করে নিয়েছে। এই কাজের ‘খরচ’-এর জন্য প্রতি সদস্যকে প্রতি তিন মাস অন্তর তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছে। শুধু অফিস খরচের জন্য সিন্ডিকেটটি ১০ বছরে চাঁদাবাজি করেছে পাঁচ কোটি টাকা।

তারা জানান, ২০১২ সালে দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য খাদ্য পরিবহনের কাজ দেয় অধিদপ্তর। ওই সময় ঠিকাদার ছিলেন ৪১০ জন। সেই সময় অফিস ম্যানেজের জন্য সদস্যদের কাছ থেকে এককালীন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে আদায় করে কমিটি। যার পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা। এরপর ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দরপত্র ছাড়াই পরিবহন কাজ করেন ঠিকাদাররা। এই চার বছরও প্রতি তিন মাস অন্তর তিন হাজার টাকা করে চার বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়। ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিয়মমতো খাদ্য পরিবহন করলেও ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সেই পুরোনো কায়দায় দরপত্রবিহীন কাজ করছেন ঠিকাদাররা। ২০১৮ সালে ঠিকাদারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৬৮ জন। তাদের কাছ থেকে প্রতি তিন মাসে আদায় করা হয় ১৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। বছরে আদায় করা হয় ৫৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে সর্বশেষ ৪ বছরে চাঁদাবাজি করেছে ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সিন্ডিকেটটি গত এক যুগে শুধু ঠিকাদারদের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে ৫ কোটি টাকা।

সাধারণ ঠিকাদারদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মাহমুদুল হক ১৪ বছর আগে প্রভাব খাটিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ঠিকাদার সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রতি দুই বছর অন্তর সমিতির নির্বাচন হওয়ার নিয়ম থাকলেও ২০২৪ পর্যন্ত সেখানে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। প্রতিবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এভাবে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। ২০১৮ সালের পর থেকে চট্টগ্রামে আর নতুন করে কোনো ঠিকাদারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। 

ভুক্তভোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ টিটু খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটি পক্ষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতেই তারা নির্বাচন করেছেন। প্রতি তিন মাস অন্তর দরপত্র রিনিউ করতে কত টাকা খরচ করতে হয় তা তারা জানেন না। অথচ প্রতি সদস্যের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে আদায় করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটিতে উভয় পক্ষের নেতৃত্ব থাকলে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। আমরা সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা চায় না সংগঠনে স্বচ্ছতা আসুক।’ 

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়ে মাহমুদুল হক আত্মগোপনে। তার অবর্তমানে নির্বাচন ও ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ। মাসুদের নামে বেনামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সমিতির নির্বাচনি প্রচার, মনোনয়ন ফরম জমাদান কিছুতেই ছিলেন না মাহমুদুল হক। প্রতিপক্ষরা বলছেন তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা থাকায় তিনি পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। একজন পলাতক ব্যক্তি কীভাবে নির্বাচন করেছেন? তার স্বাক্ষর কে দিয়েছেন? নিশ্চয় জালিয়াতি হয়েছে।

আরেক ঠিকাদার ও নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী এস এম আবুল মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, মাহমুদুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট যে চাঁদা আদায় করেছে, তার ভাগ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাননি। তার কাছে কেউ ভয়ে টাকা দাবি করতে পারতেন না। অথচ সদস্যদের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে।

মাহমুদুল হকের ঘনিষ্ঠ ও ব্যবসায়ী অংশীদার আবদুর রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, মাহমুদুল হক আওয়ামী লীগ নেতা হলেও তিনি সেই প্রভাব চট্টগ্রামের সাধারণ ঠিকাদারদের মাঝে খাটাননি। বরং তিনি সবাইকে শান্তিতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি যতদিন ধরে ঠিকাদারদের সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ততদিন ধরে সব ঠিকাদার লাভবান হয়েছেন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঠিকাদার স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছু তিনি সহজেই আদায় করতে পারেন। তাই তিনি জনপ্রিয়। এ কারণে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই তিনি ভোটে এগিয়ে আছেন বলে তারা শুনেছেন। 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়ছার আলী খবরের কাগজকে বলেন, মামলার কারণে তারা খাদ্য পরিবহনে দরপত্র আহবান করতে পারছেন না। একটি মামলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে, অপরটি ঢাকায়। যে কারণে বাধ্য হয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর দরপত্র রিনিউ করে দিচ্ছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দুটি গ্রুপ তদবির করছে। আদালতের সিদ্ধান্ত পেলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা যাবে। তাতে সরকার রাজস্ব পাবে। দরপত্র রিনিউর সময় অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

তথ্যমতে, দেশে সরকারিভাবে আমদানি করা খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও ক্রয়কৃত খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে খাদ্যগুদাম। গম মজুতে পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্য চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসব ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।

ডুবতে বসেছে গুলিবিদ্ধ মোশাররফের স্বপ্ন

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ পিএম
ডুবতে বসেছে গুলিবিদ্ধ মোশাররফের স্বপ্ন
দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় মোশাররফ হোসেন। ছবি: বাসস

স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে কষ্ট করে হলেও পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ডুবতে বসেছে। পাশাপাশি পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় মোশাররফ হোসেন (৪০)। দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই নিজের আর পরিবারের ভাগ্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন তিনি। 

রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন মোশাররফ হোসেন। সেখানে দেখা যায়, পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বেডে শুয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। দুই পায়ে গুলি লাগলেও তার ডান পায়ের অবস্থা বেশি খারাপ। চিকিৎসকরা সর্বশেষ ড্রেসিং করে ক্ষত স্থানে সেলাই করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘এখন আমার কোনো আয় নেই। বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে যা পান তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চলছে। আমার পায়ের সঙ্গে যেন পুরো পরিবারও পঙ্গু হয়ে গেছে। সাতজন মানুষের সংসার কীভাবে চলবে? ঢাকা মেডিকেলে আসার আগে জমানো প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে, তাতে কিছুই হয়নি।’

মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আমার পা ঠিক হোক। আমি যেন কাজ করে খেতে পারি। ১ লাখ, না ৫ লাখ টাকা দিলেও আমার তো চলবে না। আমার চাওয়া হলো, পা যাতে ঠিক হয়ে যায়। আমি যেন নিজে পরিশ্রম করে খেতে পারি। মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে পারি। পুরো পরিবার নিয়ে যেন খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।’

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় বিজয় মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা নানাদিক থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালায়। মোশাররফও সেদিন বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে মাওনা চৌরাস্তার সামনে গেলে গুলিতে আহত হন। 

মোশাররফ হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের শালীহর গ্রামে। তার বাবা মো. নাজিমউদ্দিন (৬৫) এবং মা নূরজাহান বেগম (৫৫)। সংসারে দুই মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন বাবা-মা ও এক বিধবা বোন। মোশাররফের বড় মেয়ে শারমিন আক্তার মিম (৮) মাওনায় একটি মাদরাসায় পড়ছিল। বাবা আহত হওয়ার পর যাতে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য তাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট মেয়ে জিনিয়া আক্তার মিমের বয়স আড়াই বছর। পোশাককর্মী মোশাররফের আয়ের ওপরই চলত সাতজনের ভরণপোষণ। 

শুরু থেকেই মোশাররফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল ৫ আগস্ট। আমি মাওনা চৌরাস্তার সামনে বিজয় মিছিলে ছিলাম। সৌখিন ও এনা পরিবহনের দুটির বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। পরে বাস দুটির গতিরোধ করে ছাত্র-জনতা। এ সময় বাসে থাকা অস্ত্রধারীরা গুলি চালানো শুরু করে। তাদের ছোড়া গুলি এসে আমার পায়ে লাগে বিকেল ৪টার দিকে। তার আগেই দুপুরে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গুলি লাগার পর ছাত্র ভাইয়েরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ঢাকায় ঢোকার তখন সুযোগ ছিল না। শেখ হাসিনা যাওয়ার পরও ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালাচ্ছিল। ময়মনসিংহ হাসপাতালে ঢোকার ১০ মিনিট পরই শুনতে পাই, গেটে ছাত্রলীগ ঝামেলা করেছে। কোনো লাশও ঢুকতে দিচ্ছে না। হাসপাতালে ঢোকার পর চোখের সামনেই একটা ছেলের মৃত্যু হয়। আধা ঘণ্টা পর দেখি আরও লাশ আসছে। জানতে পারি ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী কাউকে পেলেই কুপিয়ে হত্যা করছে। আমার প্রচুর রক্ত বের হচ্ছিল, পাশাপাশি চলছিল স্যালাইন। পরে চিকিৎসকরা ড্রেসিং করে সেলাই করে দেন।’

মোশাররফ বলেন, ‘১৩ আগস্ট ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ভাসকুলার ডিজিজ হাসপাতালে আমাকে রেফার করা হয়। গত ১৯ আগস্ট সেখান থেকে আবার পাঠানো করা হয় ঢামেকে। সেই থেকে আমি এখনো ঢামেকে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে দুবার অপারেশন হয়েছে। রক্তনালি জোড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই দিন পর আবার ছুটে যায়। ভেতরে ইনফেকশনও হয়ে যায়। ডাক্তার জানিয়েছেন ড্রেসিং করে রাখতে হবে। শুনেছি চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। আমি সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি সবার কাছে এই দোয়া চাই।’

ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘মোশাররফের ডান পায়ের ঊরুতে গুলি লেগেছে। এতে পায়ের প্রধান রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে। আমাদের এখানে তাকে কৃত্রিম রক্তনালি দিয়ে গ্রাফ করা হয়। গ্রাফ করে প্রাইমারি কাজ চালু করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গ্রাফটা টেকেনি। রক্তনালি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। তারা তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই রোগীর বিষয়ে অমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’

সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট তৈরির জন্য সব কাগজপত্র নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার এনআইডিতে একটু সমস্যা আছে, তাই পাসপোর্ট হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।’
সূত্র: বাসস

লণ্ডভণ্ড কমিউনিটি পুলিশিং

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৯ এএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫২ এএম
লণ্ডভণ্ড কমিউনিটি পুলিশিং
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘আগে রাত হলেই পাড়া-মহল্লায় পুলিশের টহল ও আনাগোনা দেখা যেত। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা আড্ডা দিতেন, তারা গল্প করার পাশাপাশি মহল্লার নানা খোঁজখবর নিতেন। এতে করে মনে একটা সাহস বা স্বস্তি কাজ করত। এখন আর কাউকেই দেখা যায় না। রাত হলে এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের আতঙ্ক বাড়ে।’

কথাগুলো বলেছেন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার জেরিন নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইয়ানুস আলী। কেবল তিনি নন, একই বিষয়ে আলাপকালে প্রায় অভিন্ন মন্তব্য পাওয়া গেছে আরও কয়েকজনের কাছ থেকেও। আলাপকালে তারা বলেছেন, পুলিশের সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত ‘কমিউনিটি পুলিশিংয়ের’ মাধ্যমে আগে পাড়া-মহল্লার স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করত থানা পুলিশ। কিন্তু জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীর আগের কাঠামোর পাশাপাশি ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, বিগত সরকারের সময়ে কমিউনিটি পুলিশের সঙ্গে কাজ করতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী। কিন্তু সরকার পতনের পরই তাদের বেশির ভাগ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকেই এখন আত্মগোপনে। তবে বিএনপি বা অন্য কোনো সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এখনো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে কমিউনিটি পুলিশে লোকবল বলতে এখন আর কিছুই নেই। 

জানা গেছে, মূলত লোকবল সংকটের কারণেই কমিউনিটি পুলিশের ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সংশ্লিষ্টদের হিসাবমতে, গড়ে ৮১২ নাগরিকের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন একজন মাত্র পুলিশ সদস্য। অথচ ভারতে এবং উন্নত বিশ্বে পুলিশ সদস্যের এই আনুপাতিক হার চার থেকে পাঁচগুণেরও বেশি। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, “কমিউনিটি পুলিশিং এখন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ আছে। কমিউনিটি পুলিশের আগে যেসব কমিটি ছিল, সেগুলোর আর অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া ওই সব কমিটির প্রধান বা মূল ব্যক্তিদের নিয়েও আগে স্বেচ্ছাচারিতা বা পক্ষপাতের অনেক অভিযোগও ছিল। সবমিলে কমিউনিটি পুলিশিং নতুন করে আর সচল করা হয়নি। তবে বর্তমানে পুলিশের উদ্যোগে ‘নাগরিক কমিটি’ বা সিটিজেন ফোরাম নামে নতুন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।” 

নাগরিক কমিটি সম্পর্কে ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, ‘এটি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো নয়, নাগরিক কমিটির কাজ মূলত পুলিশকে পরামর্শ ও মতামত দিয়ে সহায়তা করা। সবেমাত্র কাজটি শুরু হয়েছে। নাগরিক কমিটি সংশ্লিষ্ট থানার আওতাধীন সমাজের গণমান্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। থানা পুলিশ তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে মতবিনিময়সহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।’

এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি জানতে গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) কথা হয় ডিএমপির একাধিক থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে। তাদের মধ্যে তেজগাঁও থানার ওসি মো. মোবারক হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার থানার আওতায় বর্তমানে নাগরিক কমিটি বা সিটিজেন ফোরামের কার্যক্রম চলছে। এটি পুলিশের নতুন উদ্যোগ। যে উদ্যোগের মধ্যে আমরা নাগরিকদের কাছ থেকে প্রত্যাশাগুলো জানতে চাচ্ছি। পুলিশের দৈনন্দিন কাজের বিষয়েও পরামর্শ নিচ্ছি। গত ৫ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানার হলরুমে দলমত নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, শিক্ষক, একাধিক ধর্মীয় নেতাও অংশ নেন।’ তিনি বলেন, ‘আগে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে পুলিশ জনগণের কাছে গিয়ে পাড়া-মহল্লার নানা তথ্য সংগ্রহসহ অভিযানিক সহায়তা নিত। বর্তমানে এ কাজগুলো পুরোপুরি বন্ধ আছে। তবে শিগগিরই এ-জাতীয় পুলিশিং আবারও শুরু হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।’

একই বিষয়ে আলাপকালে রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমাজের সম্মানিত নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে আমরা ইতোমধ্যেই নানা বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। জনগণ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করলে আমরাও সহজেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন ঘটাতে পারব।’ 

এ বিষয়ে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অপরাধের যে ধরন ও বাস্তবতা, সে অনুসারে সমাজের সহযোগিতা বা ভূমিকা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য কমিউনিটি পুলিশিং খুবই কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত সময়ে অনেক ক্ষেত্রে এই কমিউনিটি পুলিশিং রাজনৈতিক প্রভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা জানতে পারি। ফলে রাজনৈতিক  গুরুত্ব না দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিটিতে রেখে কমিউনিটি পুলিশিং করা গেলে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে।’ 

ঢাবির সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে বর্তমানে জমিজমা দখল বা মালিকানা বিরোধ, কিশোর অপরাধ, চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত কমিউনিটি পুলিশিং অথবা এই বৈশিষ্ট্যের কোনো ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করা গেলে সমাজের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।’

এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং অবশ্যই প্রয়োজন। এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা আছে। সেটা যেকোনো নামে বা ‘ফরম্যাটে’ হতে পারে। কারণ একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাটসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয় না। তখন পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হয়। তাছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড়সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজনও হবে না।’ 
নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। জনগণের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক থাকলে অপরাধসংক্রান্ত আগাম তথ্য পাওয়া যায়, তাতে করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আবার কোনো অপরাধ ঘটে গেলেও তদন্তে ভালো সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ফলে কমিউনিটি পুলিশিং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।’

৮১২ নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন: পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার (১৭৩.৫২ মিলিয়ন)। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ পুলিশে বর্তমানে মোট জনবলের সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৮১২ জন নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৃহৎ জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্য অপ্রতুল। তাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো যেকোনো ব্যবস্থায় জনগণকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারলে পুলিশের একার পক্ষে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কমিউনিটি পুলিশিং কী: বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট পিলের গণমুখী পুলিশিং এর মূলনীতি থেকেই মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা আসে। কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ সমস্যা সমাধানে পুলিশ ও জনগণের যৌথ অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার একটি পুলিশিং দর্শন। বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে র্কাযকরভাবে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং যেভাবে শুরু: ১৯৯৪ সালে দেশে প্রথম কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা থেকে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়। তৎকালীন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম‍ শহীদুল হক, যিনি পরবর্তী সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন। তিনিই মূলত এই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটান। সে সময় ময়মনসিংহে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় চুরি, ছিনতাই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন এসপি আহমাদুল হক গঠন করেন ‘টাউন ডিফেন্স পার্টি’। এটি মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের একটি অংশ। ঠিক সে সময়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম শহীদুল হক কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে কাজ শুরু করেন, যা পরবর্তী সময় ডিএমপিসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ তথা অপরাধ যাতে ঘটতে না পারে সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে।

পাতে ফিরবে বিলুপ্তপ্রায় শাল বাইম

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ এএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ এএম
পাতে ফিরবে বিলুপ্তপ্রায় শাল বাইম
বিলুপ্তপ্রায় শাল বাইম। ছবি: সংগৃহীত

এক সময় বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরে শাল বাইম মাছ পাওয়া যেত। নির্বিচারে বিভিন্ন ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ শিকার, জলাশয়ের পানি সম্পূর্ণ সেচে মাছ ধরা এবং অন্যান্য পরিবেশগত কারণে দিন দিন এ মাছের প্রাচুর্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে। মাছটিকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করতে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।

সে ধারাবাহিকতায় বিলুপ্তপ্রায় শাল বাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে এ মাছটি এখন চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেজন্য বিপুল পরিমাণ পোনা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানান, মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৪ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের হাওরসহ ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে এ মাছ সংগ্রহ করে স্বাদুপানি কেন্দ্রের পুকুরে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্র থেকে ২০২২ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে শাল বাইম মাছের কিছু পোনা উৎপাদনে সফলতা আসে। এখনো পুরোদমে চলছে গবেষণা। প্রচুর পরিমাণে পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে সেগুলো সারা দেশের হ্যাচারিগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। মাছটি ব্যাপকভাবে চাষাবাদের আওতায় আনতে পারলে বাজারে এর দাম কমবে। ফলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাতে ফিরবে পছন্দের এই মাছ।

বিএফআরআইয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘শাল বাইম পানির তলদেশে বসবাস করে। এক নদী থেকে অন্য নদীতে মাইগ্রেশন করে থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম শাল বাইমে ৩০৩ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। যেখানে অন্য মাছের ক্ষেত্রে তা প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ১১০ ক্যালরি। প্রকৃতিতে শাল বাইম দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ৯১ সেন্টিমিটার এবং আবদ্ধ জলাশয়ে ৫১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পাওয়া যায়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওর এবং ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে সংগ্রহ করা এ মাছের ওজন সর্বোচ্চ ৫২০ গ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে।’

তিনি বলেন, শাল বাইম নিশাচর মাছ। এরা রাতের বেলায় খাবার খায়। খাদ্য হিসেবে চিংড়ি, মাছের লার্ভা, কেঁচো, ট্রাস ফিস ও অন্যান্য জলজ কীট গ্রহণ করে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে পুরুষ ও স্ত্রী মাছের পার্থক্য করা একটু কঠিন। প্রাপ্তবয়স্ক প্রজননক্ষম পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিলে সাদা মিল্ট এবং স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে ডিম বের হয়ে আসে। প্রতি ২৬০ মিলিমিটার থেকে ৫৩৫ মিলমিটার সাইজের শাল বাইম মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৩ হাজার ১৫৫টি থেকে ২৪ হাজার ৬৮৪টি পর্যন্ত হতে পারে। মাছটির প্রজননকাল মে থেকে জুলাই মাস।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র বলেন, দেশে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে ৬৪ প্রজাতির মাছ ছিল বিলুপ্তপ্রায়। এসব মাছ খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে ৪০ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ১২ প্রজাতির মাছ চাষাবাদের আওতায় এসেছে।

তিনি বলেন, সর্বশেষ শাল বাইম মাছের কৃত্রিম প্রজননের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে এ মাছটি এখন চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। সেজন্য বিপুল পরিমাণ পোনা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। ধীরে ধীরে বিলুপ্তপ্রায় সব মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে নিরলসভাবে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মশিউর রহমান আরও বলেন, প্রজনন মৌসুমে গবেষণা পুকুর থেকে সুস্থ সবল পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে সংগ্রহের পর হ্যাচারিতে সিমেন্টেড সির্স্টানে অক্সিজেন প্রবাহসহ কৃত্রিম ঝরনায় ৫-৬ ঘণ্টা রাখা হয়। পরে হরমোন ইনজেকশনের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে বাচাই করা হয়। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে কেজিপ্রতি নির্দিষ্ট হারে পিটুইটারী দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়। ইনজেকশন প্রয়োগ করে সিস্টানে স্থাপিত হাপায় ১:১ অনুপাতে স্থানান্তরের মাধ্যমে আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা হয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের ৩৫-৪৫ ঘণ্টা পর প্রাকৃতিকভাবে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে। সম্পূর্ণ ডিম দেওয়া শেষ হলে ব্রুড মাছগুলোকে হাপা থেকে সরিয়ে নিতে হয়।

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });