রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী চতুর রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এদের মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ কেউ আছেন আত্মগোপনে। আবার অনেকে আছেন কারাগারে। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা সমুদয় অর্থ জব্দ করেও সরকারের পাওনা আদায় করা সম্ভব হবে না। আইনি জটিলতায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে বসে নেই এনবিআর, খুঁজছে নতুন পথ।
বিগত সরকারের ১ হাজার ১২৮ জন প্রভাবশালীর কাছ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব কবে নাগাদ আদায় হবে, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রভাবশালী এসব রাজস্ব ফাঁকিবাজের কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আদায় করা সম্ভব, তা নিয়ে কৌশল নির্ধারণে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। নেওয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এক হাজারের বেশি ব্যক্তির রাজস্ব ফাঁকির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এদের আয়ের বৈধ উৎস না থাকায় অনেকে ব্যাংকের লেনদেন এড়িয়ে বাড়িঘরে, অন্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন। অনেকে অর্থ পাচার করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় অনেকে অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে টাকা সরিয়েছেন। তাই এসব ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলেও সেখানে থাকা সামান্য অর্থ দিয়ে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পরিশোধ করা যাবে না।
সিআইসি সূত্র জানায়, বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের অনেকের বাড়ি, ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ জমিজমার মালিকানা দলিলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে সময় লাগছে। অনেকে আবার ফাঁকি দেওয়া টাকায় অন্যের নামে সম্পত্তি কিনেছেন। এসব সম্পত্তির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর জোগাড় করতে সময় লাগছে। আবার অনেকের সম্পদের খোঁজে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কাগজপত্র ভুয়া। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের বেশির ভাগের এ ধরনের সম্পদ রয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন মেনে এসব সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হলে দলিলপত্র জোগাড় করে নিলামে তুলতে হবে, যা বেশ ঝামেলাসাপেক্ষ।
এনবিআর সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ আবু দাউদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআর প্রভাবশালীদের রাজস্ব ফাঁকির অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিলে তারা মামলা করে দিতে পারেন। মামলা করা প্রতিটি নাগরিকের আইনি অধিকার। এ ক্ষেত্রে মামলা কতদিনে নিষ্পত্তি হবে তা আমার কেন- কার পক্ষেই বলা সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে কয়েক হাজার রাজস্বসংক্রান্ত মামলা আদালতে জমে আছে। এনবিআর থেকে এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যায়ে রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি।’
আদালতে ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর ফলে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে প্রতি দিনই নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। পুরোনো অনেক মামলা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলমান রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের এসব ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তাদের অবৈধ ও বৈধ সব অর্থ পাচার করে দিয়েছেন। পাচারের অর্থ ফেরত এনে এবং সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পাচারের অর্থ আদায়ের প্রথম ধাপে রাজস্ব আইনের পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতেও এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এরপর বিদেশে ল ফার্ম নিয়োগ দিয়ে আইনি পথে পাচারের অর্থ আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে বিদ্যমান রাজস্ব আইনেও কিছু ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনটির বিশেষ কিছু ধারার আওতায় মামলা করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে পুরো আদায় প্রক্রিয়াটি ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এনবিআরের প্রাথমিক তদন্তে বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভার চেয়ারম্যান, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীসহ মোট ১ হাজার ১২৮ জন ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানা গেছে। এদের প্রত্যেকের নামে-বেনামে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। রয়েছে হাজার একরের বেশি জমি। বিশেষভাবে সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, দীপু মনি ও তার ভাই, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, জুনায়েদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রী কনিকার নামে শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকার প্রমাণ রয়েছে। নিজেদের এলাকাতে শত একর জমি, একাধিক মাছ ও গবাদিপশুর খামার থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব সম্পত্তির দলিলপত্রের খোঁজ চলছে। সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের নামেও হাজার একরের বেশি জমি থাকার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। আরও প্রমাণ জোগাড়ে কাজ চলছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আটঘাট বেঁধে রাজস্ব ফাঁকি দেন। এদের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করা কঠিন। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই সম্ভব।’
অন্যদিকে বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডসহ মোট ৩৭ প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে রাজস্ব পরিশোধযোগ্য অর্থ নেই বলে সূত্র জানিয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে সায়ান ফজলুর রহমান, সালমান এফ রহমানের ভাই এ এস এফ রহমান ও তার ছেলে শাহরিয়ার রহমানের ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদের নিজেদের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা তাদের কাছে পাওনার চেয়ে অনেক কম। অন্যের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব তারা পরিচালনা করেছেন কি না, তার খোঁজ চলছে। এদের ভোগদখল করা সম্পত্তির মালিকানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে। সেসব দলিলের খোঁজ চলছে। এসব ব্যক্তির পাচার করা ৩৩ হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে রাজস্ব আদায়ে কাজ করছে সরকার।
এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এসব ব্যক্তির নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করা ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টিও এনবিআর খতিয়ে দেখছে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর ফাঁকিবাজরা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন এনবিআর স্বচ্ছতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করতে কাজ করছে। যদি কোনো জটিলতা থাকে তবে তার সমাধান করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করা হবে। এ বিষয়ে এনবিআর কঠোর অবস্থানে আছে।