উন্নত বিশ্বের নামিদামি শহরের মতো আধুনিক দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতির সংযোজন রাতের আঁধার কাটিয়ে রাজশাহী নগরকে করে তোলে আলোকিত। দেশের প্রথম সিটি হিসেবে রাজশাহী নগরের সড়কে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে আলো দেয় সড়কবাতি। আবার কোথাও স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে মুকুটবাতি। সিল্কসিটি, ক্লিনসিটি, গ্রিনসিটির পাশাপাশি সড়কবাতির কারণে রাজশাহী নতুন করে তকমা পায় ‘আলোর শহর’ হিসেবে। তবে বিদেশ থেকে আনা দৃষ্টিনন্দন এই সড়কবাতি দিয়ে শহরকে আলোকিত করতে গিয়ে বর্তমানে বিপাকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। মাত্র ২৩ কিলোমিটার পথ আলোকিত করতে গিয়ে ঘারে চেপে বসেছে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া। বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে রাসিকের সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে বলে জানিয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কর্তৃপক্ষ।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্প শুধু সরকারি সম্পদের অপব্যবহার নয়, এটা অপচয়ও বটে। এর দায়ভার বহন করতে হবে জনসাধারণকে। এদিকে বকেয়া বিলের কারণ হিসেবে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের উদাসীনতাকে দুষছেন রাসিকে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। শুধু মধ্যশহরে অতিরিক্ত সড়কবাতি লাগিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। এখন বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে রাসিক। তারা জানায়, বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কমানো হচ্ছে সড়কে আলোকবাতির সংখ্যাও।
রাসিক সূত্রে জানা যায়, নগর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১০৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে নান্দনিক সড়কবাতিগুলো স্থাপন করে সিটি করপোরেশন। আলোর ঝলকানিতে শহর সাজাতে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা-বন্ধগেট, তালাইমারী-কোর্ট, তালাইমারী-কাটাখালী ও আলিফ-লাম-মিম ভাটার মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথে আছে আধুনিক এসব সড়কবাতি। আলোর তীব্রতা বিশ্লেষণ করে প্রায় ১৫ মিটার দূরত্বে বসানো হয় এসব বাতি। নান্দনিক এসব সড়কবাতি আনা হয় তুরস্ক, চীন ও ইতালি থেকে।
আরও জানা গেছে, নগরের ১৮টি পয়েন্টে উঁচু উঁচু ফ্লাডলাইটও বসানো হয়েছে বিদেশ থেকে এনে। এতেই করপোরেশনের কাঁধে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ বিল। এদিকে এরই মধ্যে সড়কের বাতি কমিয়ে ফেলেছে সিটি করপোরেশন। একটির পর একটি বাতি জ্বালাছেন তারা। অন্যদিকে নান্দনিক বাতির অনেকগুলোই নষ্ট হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের আগে। প্রতিদিনই রক্ষণাবেক্ষণ করে এগুলো সচল রাখা হচ্ছে।
নেসকোর বাণিজ্যিক পরিচালন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, রাসিকের বকেয়া বিল আগে থেকেই থাকত। তবে কয়েক বছর ধরে সড়কবাতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বকেয়া বিলের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন বকেয়া সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বকেয়া পরিশোধে মাঝেমধ্যেই রাসিকে চিঠি পাঠানো হয়। তবে বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি। নাগরিক সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নও করা হচ্ছে না।
তবে নাম না প্রকাশ করে নেসকোর এক উপমহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, রাসিকের বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি এতদিন রাজনৈতিক সমঝোতায় চলেছে। তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাই এসব বকেয়া উদ্ধারে আমরা তৎপর হয়েছি।
তবে রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ বি এম শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘শুধু সড়কবাতি নয়, এই বকেয়া নগরের চারটি জোনের পানির পাম্প, বিভিন্ন স্থাপনা ও আরবান হেলথ কেয়ারে ব্যবহৃত বিদ্যুতের। প্রতি মাসের বকেয়া পুঞ্জীভূত হতে হতে একটা বিরাট অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য রাসিকের নেই। সে কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকা বকেয়া বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার ও রাসিকের প্রশাসক ড. মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে অতিরিক্ত সড়কবাতি। কেননা, এগুলো ঘিঞ্চিভাবে লাগানো হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অর্থ অপচয় করা হয়েছে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি। যেখানে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে ঠিক করব।’
রাজশাহী জেলা সুজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই সড়কবাতিগুলো ছিল রাজনৈতিক প্রকল্প। অথচ যে বাড়তির টাকা বকেয়া হয়েছে তা সিটি করেপারেশনের জনগণের হল্ডিং ট্যাক্স ও অন্যন্য কর থেকে আদায় করা হবে। কিন্তু এমন বিলাসিতার খেসারত নগরবাসীকে কেন দিতে হবে। এটি কাম্য নয়।’