এতিমদের জন্য বিশাল অট্টালিকা। মন জুড়ানো আলিশান বিল্ডিং। ভালোভাবে নির্মাণ করতে পরামর্শকের পেছনেই খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। ২০ হাজার বর্গফুটের প্রবীণ নিবাসও নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের ব্যবহারের জন্য প্রায় কোটি টাকা খরচ করে নামিদামি আসবাবপত্রও কেনা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে ২৮ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে ‘প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্যকেন্দ্র, মাগুরা প্রকল্পে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো এতিম। নেই তেমন প্রবীণ।’
সরকারি টাকা খরচ করে তিন বছরে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্ট বাস্তবায়ন করেছে প্রকল্পটি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্প পরিচালক ও মাগুরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. জাহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আমরা উদ্যোগী সংস্থা প্রফুল্ল প্রতিভার মালিক স্বপন কুমার ঘোষের কাছে হস্তান্তর করি। তারা দেখভালো করছেন। কাজেই কিছু জানতে হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’
কোনো এতিম নেই, তেমন প্রবীণও নেই- আপনাদের দেখার কিছু নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে মাগুরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, ‘আমরা আইএমইডি রিপোর্ট হাতে পাইনি, তা পেলে দেখব কেন ভালো করে প্রকল্প করা হলেও এতিম নেই।’ পরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
আইএমইডি ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সূত্র মতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকার ও মাগুরা ও পার্শ্ববর্তী জেলার প্রবীণ ও এতিমদের সহায়তা, প্রবীণ ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা ও এতিম শিশুদের পরিচর্যা, নিরাপত্তা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের অনুদানে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচের অনুমতি দেয় সরকার। মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছর। ওই সময়ে পুরো কাজ হয়নি। পরে এক বছর সময় বাড়ানো হয়। অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ে প্রকল্পটি শেষ হয় এবং খরচ করা হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে ২০ হাজার বর্গফুটের ৫ তলাবিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ১০ কোটি টাকা খরচ করে ২ হাজার বর্গফুটের এতিমখানা ভবনও নির্মাণ করা হয়। ৫০ জন প্রবীণের নিরাপদ আবাসন এবং ৫০ জন এতিম ও পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত শিশুদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের ব্যবহারের জন্য কোটি টাকার অত্যাধুনিক আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। বিল্ডিং দুটি ভালোভাবে নির্মাণ করার জন্য দেখভালো করতে পরামর্শকের পিছনে ৪০ লাখ টাকাও খরচ করা হয়েছে। ৫ লাখ টাকার বইপুস্তকও কেনা হয়েছে। এসব কাজ করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২৭ লাখ টাকা বেতন-ভাতাও দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে ২৮ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ১০০ ভাগ। কিন্তু সেখানে বর্তমানে মাত্র ৩ জন প্রবীণ বাস করছেন। কোনো এতিম নেই। তবে ভৌত কাজের মান ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফিজিওথেরাপি মেশিনও কেনা হয়েছে। এতে প্রায় কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবল দিয়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রকল্পের টাকা ঠিকমতো খরচ হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হলে ৭টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এই আপত্তি দ্রুত দ্বিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে তার প্রমাণ আইএমইডির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্তকরণ প্রতিবেদন (পিসিআর) আইএমইডিতে প্রেরণের নিয়ম থাকলেও এ প্রকল্পে তা করা হয়নি। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পাঠানো হয়েছে। আইএমইডির পরিচালক মুহাম্মদ কামাল হোসেন তালুকদার গত ৫ অক্টোবর প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা প্রদানের জন্য প্রকল্পটি করা হলেও সমাজের পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিতরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে জলে গেছে পুরো টাকা।