মতিউর রহমান মতি একসময় ছিলেন আদমজী পাটকলের শ্রমিক। যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে এই শ্রমিক হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। দেশে-বিদেশে গড়েছেন বাড়ি, মার্কেট ও দোকানসহ অঢেল সম্পত্তি। কীভাবে শ্রমিক থেকে ধনকুবের হলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক এই কাউন্সিলর, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে মামলাও করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দদুক)। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় লুটপাট থামেনি তার।
স্থানীয়রা বলছেন, জমি দখল, চাঁদাবাজি, আদমজী ইপিজেডের ঝুট সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ, চোরাই তেলের কারবার আর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেই বিপুল সম্পদ গড়েছেন এই যুবলীগ নেতা। এখনো লোকজন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন এসব সেক্টর। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় সরাসরি অংশ নিতে দেখা যায় তাকে। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি মতিউর রহমান মতি। তার বাবা ১৯৭১ সালে ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির রাজনীতি থেকে উত্থান ঘটে মতির। পরবর্তী সময়ে যোগ দেন আওয়ামী যুবলীগে। ২০১৪ সালে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য হলে মতি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। টানা ১০ বছর রাজত্ব করেন সিদ্ধিরগঞ্জে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি জমি দখলে মরিয়া ছিলেন মতি। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পেতেন নিয়মিত চাঁদা। আদমজী ইপিজেডের কারখানাগুলোর ঝুট সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত পদ্মা ও যমুনা তেলের ডিপোর নিয়ন্ত্রণও করতেন এই মতি। সেখানে চোরাই তেলের কারবার করে পেতেন বিপুল অর্থ। মতির রয়েছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী পানি আক্তার নিয়ন্ত্রণ করতেন কিশোর গ্যাং। বাড়ি থেকে নিরীহ মানুষকে ডেকে এনে হয়রানি করতেন এই যুবলীগ নেতা। ওই সময় রাজনৈতিক প্রভাবে থানা পুলিশ দিয়ে হয়রানি ও মামলা করা ছিল মতির নিয়মিত কাজ।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর গা ঢাকা দেন মতিউর রহমান মতি। তবে তার সহযোগীরা এখনো রাজত্ব ধরে রাখতে মহড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়দের মধ্যে এখনো মতি বাহিনীর আতঙ্ক কাটেনি। তাই অভিযোগ তুলে ধরলেও নাম প্রকাশ করতে চান না অনেকেই।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মতি ও তার স্ত্রী রোকেয়া রহমানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুদক। মামলায় মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকার অধিক সম্পদের তথ্য গোপনসহ প্রায় ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। বিভিন্ন ব্যাংকে ৮২ কোটি ৫১ লাখ ৪২৪ টাকা জমানো ছিল তার। সেখান থেকে ৭৪ কোটি ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৯ টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য গোপন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হলে আদালত থেকে জামিন নেন। এ সময় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মতি। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা থাকায় সরকারি দপ্তরগুলোও চলত মতির কথায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা মতির সিদ্ধিরগঞ্জেই অন্তত ১২টি বাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে আইলপাড়ায় ডুপ্লেক্স বাড়িসহ সাতটি বাড়ি, সাইলো এলাকায় ছয়তলা বাড়ি, কদমতলীতে তিনতলা বাড়ি রয়েছে তার। অন্য টিনশেডের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়েছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় (বসুন্ধরা-উত্তরা) একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। কদমতলীতে সরকারি জায়গা দখল করে গড়েছেন বিশাল মার্কেট। সিদ্ধিরগঞ্জে সড়ক ও জনপথেরসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে নামে-বেনামে ১০টি মার্কেট গড়েছেন তিনি। সরকারি জায়গায় স্কুল নির্মাণ করে মাসিক হিসেবে ভাড়া নেন মতি। সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক চাঁদা নেন তিনি। আদজমী ইপিজেডের ৪৯টি কারখানার ঝুট ব্যবসা ছিল তার দখলে। মালয়েশিয়াতে গড়ে তুলেছেন সেকেন্ড হোম। সেখানেও তার একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কোটি টাকা মূল্যের দুটি গাড়িতে চলাচল করতেন মতি।
সিদ্ধিরগঞ্জে লুটপাট করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা মতিসহ তার সহযোগীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও হামলার অন্যতম আসামি মতিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম। তিনি বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি, দখলবাজি করে আদমজীকে সন্ত্রাসীদের নগরী বানিয়ে ছিলেন এই মতি। তার আশ্রয়দাতা ছিলেন শামীম ওসমান। আদমজী থেকে শামীম ওসমান মোটা অঙ্কের চাঁদার ভাগ পেতেন। তাই তিনি মতিকে লালন-পালন করতেন। মতির মতো দুর্ষর্ধ সন্ত্রাসীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’
সিদ্ধিরগঞ্জে মতির বিরুদ্ধে হত্যাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ওসি আল মামুন।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাবে সিদ্ধিরগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন মতি। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। তিনি বর্তমানে পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারকারী মতির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।’