জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় প্রকাশ্যে ছিনতাইকারী-টানা পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। টার্গেট ব্যক্তির মুঠোফোন, টাকা বা সঙ্গে থাকা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। ছিনতাইকারীদের নির্মমতায় অনেক সময় প্রাণহানিও ঘটছে।
ভুক্তভোগী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড পুরোদমে স্বাভাবিক না হওয়ায় রাজধানীজুড়ে ছিনতাইকারীরা এখনো বেপরোয়া। এমন পরিস্থিতিতে পথেঘাটে চলাচলকারী অনেকের মনে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও প্রতিকারের জন্য থানায় যাচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) অবশ্য বলছে, ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধের মাত্রা আগের থেকে কিছুটা কমেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গোলাপবাগে ছিনতাইকারীর টার্গেটের শিকার হন ফেনী সদরের বাসিন্দা মো. ফয়সাল। ভুক্তভোগী মো. ফয়সাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (মেসেঞ্জার) ঘটনার বিবরণ দিয়ে খবরের কাগজের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কাজে ঢাকায় এসেছিলাম। কাজ শেষে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গোলাপবাগ থেকে ফেনীর উদ্দেশে বাসে উঠে বসি। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১০টা। গোলাপবাগের হালকা যানজটে আটকে ছিল স্টার লাইন পরিবহনের সেই বাসটি। জানালাসংলগ্ন সিটে বসে মোবাইল ফোনে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় এক ছিনতাইকারী ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনটি (স্যামসাং এ-৩৪) নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। তার সঙ্গে আরও দু-তিনজন ছিল, যাদের হাতে ধারালো ছুরিজাতীয় অস্ত্র দেখা যায়। ছিনতাইকারী বলে তাৎক্ষণিক চিৎকার দিতে থাকি। তার আগেই ছিনতাইকারী দৌড়ে পালিয়ে যায়।’ ঘটনার এক দিন পর বিষয়টি জানিয়ে ভুক্তভোগী ওই যাত্রী বলেছেন, ‘এখন যে অবস্থা চলছে তাতে থানায় গেলে বা পুলিশকে জানালেও কোনো লাভ হবে না মনে করে আর কোনো পদক্ষেপ নিইনি।’
গত ১০ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় রবিউল ইসলাম নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে মুস্তাকিম আলিফ (২৫) নামে এক তরুণ নিহত হন। ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় বেড়িবাঁধে আলমগীর ব্যাপারী নামে এক দিনমজুর ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। তারও আগে ৩ সেপ্টেম্বর কদমতলীর মেরাজনগরে ছুরিকাঘাতে কাঁচামাল বিক্রেতা হাশেম ও একই দিন ভোরে হাজারীবাগে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক সাদেকিন ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে গত দুই-তিন মাসে এ রকম আরও বেশ কিছু খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অস্ত্রের মুখে শুধু ফোন বা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘পুলিশ বাহিনী টহল, চেকপোস্ট বসানো, অভিযান পরিচালনাসহ তাদের কাজ এখনো শতভাগ শুরু করতে পারেনি। পেশাদার ছিনতাইকারী ও অপরাধী চক্র এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে। যার প্রভাব হিসেবে আমরা রাজধানীর মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ অনেক স্থানে চোর-ছিনতাইকারী বা ডাকাত চক্রের তৎপরতা দেখছি।’
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পর ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি যে হারে বেড়েছিল তা কমতে শুরু করেছে। পুলিশের অপারেশনাল কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রথম সাত মাসে ৫৫৩ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে (৩ মাস ৫ দিন) মাত্র ৬৪ জনকে ছিনতাই ও ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ৬১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্যদিকে ডিএমপির পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গত আগস্ট থেকে অক্টোবরের এই তিন মাসে ডাকাতি ও দস্যুতা আইনে মোট মামলা হয়েছে ৫৩টি। মামলার এই সংখ্যাটি প্রকৃত ঘটনাগুলোর তুলনায় অনেক কম বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, আগস্ট মাসে আক্রান্ত হয় রাজধানীর অধিকাংশ থানা। বন্ধ হয়ে যায় থানার কার্যক্রম। সে সময় মামলা, অভিযোগ বা জিডি গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা চলমান ছিল না।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছিনতাই, ডাকাতিসহ সব ধরনের অপরাধ দমনে র্যাব কাজ করে যাচ্ছে। চলমান যৌথ অভিযানের পাশাপাশি টহল ও চেকপোস্ট বৃদ্ধিসহ পেশাদার অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ব্যাটালিয়ানগুলো নিজ এলাকায় ছিনতাইয়ের হটস্পট চিহ্নিত করার পাশাপাশি পেশাদার ছিনতাইকারীদের আটকের জন্য নজরদারি বাড়িয়েছে।’