সোমবার (১১ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ভবন-২)। লিফটের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন। ১০ মিনিট অপেক্ষা করেও লিফটে উঠতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে কিছু দূর উঠেই চোখে পড়ে দুই ওয়ার্ডের মাঝে করিডরে বেড। পাশে মেডিসিন ওয়ার্ড (পুরুষ)। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় সব বেডেই ডেঙ্গু রোগী। বাইরে যে ১২টি বেড, সেখানে রোগী আছেন ১১ জন। বেশির ভাগেরই হাতে স্যালাইন দেওয়া। রোগীদের পেঁপে কেটে খাওয়াচ্ছেন স্বজনরা, কেউ বা খাওয়াচ্ছেন তরল খাবার।
কথা হয় এক রোগীর পুত্রবধূ নার্গিস ফেরদৌসের সঙ্গে। শ্বশুরকে (৫৩) নিয়ে নরসিংদী থেকে এসেছেন। চার দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পাঁচ দিন জ্বর থাকায় নরসিংদীতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, রাতেই খিঁচুনি ওঠে, সঙ্গে বমি। তখনই নিয়ে ছোটেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কথা বলে জানা গেছে, শুধু এই রোগীই নন, করিডরে চিকিৎসাধীন ১১ জন রোগীর মধ্যে মাত্র তিনজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার। বাকি সাতজন ঢাকার বাইরের। একজন রোগী ঘুমাচ্ছিলেন। তার পাশে কোনো স্বজনও ছিল না। তাই তিনি কোথা থেকে এসেছেন তা জানা যায়নি। ১০ জন রোগীর মধ্যে তিনজন নারায়ণগঞ্জ, একজন আশুলিয়া, একজন সাভার, একজন শরীয়তপুর, একজন নরসিংদী, একজন কামরাঙ্গীরচর, একজন লালবাগ ও একজন এসেছেন ধানমন্ডি থেকে।
এ বছর ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৮ হাজার ৫০৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৯১৫ জন। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দাবি- ভর্তি হওয়া ১২ হাজার ৯১৫ জনের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ১৬ জন এই এলাকার বাসিন্দা। বাকি ৮ হাজার ৮৯৯ জন রোগী তাহলে কোথাকার? উত্তর সিটি করপোরেশনের চিত্রও প্রায় একই- অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী এবং সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দার সংখ্যার মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। এই ব্যবধানের কারণেই ডেঙ্গুর বিস্তৃতি নিয়ে নতুন বাস্তবতা হলো, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এখন রাজধানীর বাইরেই বেশি।
শুধু ভর্তি রোগীই নয়; মৃত্যুর বেলায়ও একই চিত্র। চলতি বছরের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোয় ১৫৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দাবি- মৃত ১৫৯ জনের মধ্যে ৩৫ জন দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা। তাহলে বাকি মৃত ১২৪ জন কোন এলাকার?
গত ৯ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আগের ২৪ ঘণ্টায় মৃত আটজনের মধ্যে চারজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হাসপাতালে। চারজনের দুজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং দুজন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, মৃত এই চারজনের মধ্যে একজন দক্ষিণ সিটি কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা। অন্য তিনজনের একজন নোয়াখালী সদর উপজেলার, একজন চট্টগ্রামের এবং একজন কেরানীগঞ্জের।
কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগীর বাসা ও বাসার আশপাশে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গুবিষয়ক খোঁজখবর নিতে গত ১০ নভেম্বর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার রুমে গিয়ে জানা যায়, তিনি আছেন কন্ট্রোল রুমে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সেখানে রাখা বড় স্ক্রিনে মনোনিবেশ করে আছেন। স্ক্রিনে চলছিল ফেসবুক লাইভ।
স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিতেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া আক্রান্ত ও মৃতদের বাসা বাড়িতে গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ৯ নভেম্বর মৃত নারীর বাসা ওইটি। মৃত ওই নারীর বাসা তালাবদ্ধ পান সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীরা। অঞ্চল ৩-এর ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের যে বাসায় তিনি বাস করছিলেন, সেই বাড়িটি নির্মাণাধীন। রোগীর বাড়ি ও আশপাশের ৪০০ মিটারের মধ্যে মশক নিধন চলছে। অন্য যে তিনজন হাসপাতালে মারা গেছেন তারা কেউই ঢাকা দক্ষিণের বাসিন্দা নন।
ডা. কবির বলেন, এখানে বড় রকমের একটা গ্যাপ থাকছে। ভুল বার্তা যাচ্ছে। প্যানিক তৈরি হচ্ছে। লোকজন মনে করছেন, দক্ষিণ সিটিতে মনে হয় আক্রান্ত এবং মৃত্যু বেশি। আসলে বিষয়টি তা নয়। দক্ষিণ সিটির হাসপাতালগুলোয় মারা গেলেই তিনি ওই সিটির বাসিন্দা হবেন- এমন ভাবার কারণ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বারবার বলা হচ্ছে, বিষয়টি খোলাসা করার জন্য। কিন্তু তারা তা করছে না। তারা যদি রোগীর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তালিকা তৈরি করেন, তাহলে সিটি করপোরেশন সেখানে গিয়ে মশা নিধনের উদ্যোগ নিতে পারে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অনেক ঠিকানায় গিয়ে রোগীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কবির জানান, ওষুধ-মেশিন-জনবল সবই পর্যাপ্ত আছে। ৭৫টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৫০ জন কর্মী কাজ করেন। প্রতিদিন দুই শিফটে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১৩ জন মশা নিধনে কাজ করেন। সকালে ৭ জন লার্ভা মারার জন্য কাজ করেন। বিকেলে উড়ন্ত মশা মারার জন্য ফগিংয়ের কাজ করেন ৬ জন।
উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গিয়েও তালিকা প্রণয়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়সারা কাজের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালিকা ধরে রোগী খুঁজতে নেমে বড় রকমের গরমিল পান তারা।
গত ২ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত কয়েকটি হাসপাতালে ২৭২ জন ভর্তি হয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমে এই তথ্য পাঠানো হয়। সিটি করপোরেশনে পাঠানো তালিকায় বলা হয়, দক্ষিণ সিটির ১২৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে যাচাই করতে গিয়ে উত্তর সিটি জানতে পারে, তাদের এলাকার রোগীর সংখ্যা মাত্র ৬৯ জন। এখানে বড় অঙ্কের গরমিল পাওয়া গেছে। ২৯-৩০ অক্টোবরও গণমাধ্যমে পাঠানো তথ্য ও ডিএনসিসিতে দেওয়া রোগীর সংখ্যার মধ্যে বড় অঙ্কের গরমিল পাওয়া যায়।
এ তথ্য পেয়ে রীতিমতো বিস্মিত উত্তর সিটির কর্মকর্তারা। তারা অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দায়সারা তথ্য দিচ্ছে, যা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা বলেন, রোগীর সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে সেসব এলাকা ধরে মশা নিধনের কাজ করলে সফলতা আসবে। আমরা মনে করি, সব রোগী যেন ঢাকা সিটির। প্রকৃত তথ্য হলো তারা রাজধানীর বাইরের। রোগীর বাসস্থান জানলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো যায়। তা না হলে কোনো উদ্যোগ ফলদায়ক হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতাল থেকে রোগী বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য রকমের দুর্নীতি কাজ করে। রোগী বেশি দেখালে বেশি খাবার আসে হাসপাতালে। সে জন্য হাসপাতালের অসাধুরা এই কাজটি করছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালগুলোয় গিয়ে রোগীর বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালিয়েছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের কাজ করেছি। লক্ষণযুক্তদের বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক শেখ দাউদ আদনান বলেন, ভর্তির সময় যে তথ্য রোগীরা দেন, তাই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়। রাজধানীর হাসপাতালে ঢাকার বাইরের বেশি রোগী আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, রোগীদের বিশ্বাস যে ঢাকায় গেলে হয়তো ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে। তবে জেলা হাসপাতালেও ডেঙ্গুর ভালো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সব হাসপাতালেই একই গাইডলাইন ফলো করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাই ঢাকায় না এসে রোগীরা যেন নিজ নিজ জেলার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে পরামর্শ দেওয়া হলেই যেন রোগীরা ঢাকায় আসেন।